শিয়ালদহ আদালত চত্বরে বসে রয়েছেন অভিযুক্তদের বাড়ির লোকেরা। শুক্রবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
হাওড়া জেলা আদালতে আইনজীবী, পুরকর্মী ও পুলিশের গোলমালের রেশ পড়েছে শহর কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন আদালতে। আইনজীবীদের প্রতিবাদ মিছিল, কর্মবিরতির জেরে বৃহস্পতিবার থেকে বহু মামলার শুনানি বন্ধ রয়েছে সে সব আদালতে। এমন অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে কী হাল সাধারণ মানুষের? বিভিন্ন আদালত ঘুরে উঠে এল ভোগান্তির নানা চিত্র।
আলিপুর আদালত
দুপুর ১২টা। আলিপুরের অতিরিক্ত বিচার বিভাগীয় বিচারকের ঘরের সামনে তিন মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থানার বাসিন্দা শাহজাদি জমাদার। একটি অপরহণের মামলায় তাঁর সাক্ষ্য দেওয়ার কথা। কিন্তু আদালতে এসে জানতে পারেন, এ দিন কাজ হবে না। কথায় কথায় জানালেন, ভোর ছ’টার সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন সাহজাদি। এক ঘণ্টা ভ্যানোতে চেপে প্রথমে ক্যানিং স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে বালিগঞ্জ। তার পরে অটোয় আলিপুর আদালত। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে এ ভাবে মাস তিনেকের শিশুকে নিয়ে আসার পরে দেখেন, কাজ হবে না। ফিরে যেতে হবে। আসতে হবে আর এক দিন।
শুক্রবার সকাল থেকেই আলিপুর পুলিশ কোর্টের মূল গেটের সামনে শামিয়ানা খাটিয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা। আলিপুর আদালত চত্বরে অধিকাংশ আইনজীবীর ঘরেই ঝুলেছে তালা। সে সব ঘরের আশপাশেই শাহজাদির মতো অসহায় ভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল বিভিন্ন মামলার সাক্ষী ও অভিযুক্তদের।
দুপুর ১টা। আলিপুর আদালত চত্বরে আইনজীবীর ঘরের দরজায় তখনও তালা বন্ধ। বন্ধ ঘরের সামনে বসে ক্যানিং থানা এলাকার হেদিয়াবাদের বাসিন্দা সইদুল ঢালি। ভাইপোকে মারধরের মামলায় এ দিন সাক্ষ্যদান ছিল তাঁর। সাতসকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু জানালেন, আদালতে এসে তাঁর আইনজীবীর খোঁজ পাচ্ছিলেন না। সইদুল বলেন, ‘‘আমার বাড়িতে টিভি নেই। খবরের কাগজও পড়ি না। আইনজীবীদের কর্মবিরতির কথা জানতাম না। জন মজুরের কাজ করি। এক দিনের রুজি তো গেলই, সঙ্গে যাতায়াত ও খাবারের খরচ বাবদ আরও শ’দুয়েক টাকা গেল।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা ইসরাফিল মোড়ল। জমি দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এ দিন তাঁর সাক্ষ্যগ্রহণ ছিল। আদালতের পরিস্থিতি দেখে নিজের আইনজীবীর কাছে যান। ইসরাফিলের কথায়, ‘‘উকিলবাবু জানালেন, আমার মোবাইল নেই। তাই যোগাযোগ করতে পারেননি। না হলে আজ আসতে হত না। এ দিকে যাতায়াতে ১০০ টাকা, সঙ্গে খাওয়ার খরচ ৫০। সবই গেল।’’ আবার কবে আসতে হবে, তা জানতেই উকিলবাবুর অফিসে বসে দিন গেল ইসরাফিলের।
শিয়ালদহ আদালত
শিয়ালদহ আদালত চত্বরে এ দিন পা দিতেই ছবিটা কিছুটা অন্য রকম ঠেকল! অন্য দিন নোটারি হলফনামা, ছোটখাটো আইনি কাজের জন্য ছেঁকে ধরেন মুহুরিরা। এ দিনও ঢুকতে সেই ডাক কানে এল বটে, কিন্তু তাতে তেমন জোর ছিল না!
আদালতকক্ষের সামনেও চেনা থিকথিকে ভিড় নেই। অভিযুক্তদের বাড়ির লোকেরা বসে রয়েছেন হতাশ হয়ে। এমনই এক যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর এক দাদা যৌন নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্ত। উকিল জানিয়েছিলেন, এ দিন জামিন হতে পারে। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু বাদী-বিবাদী, কোনও পক্ষের আইনজীবীরা নেই বলে মামলার শুনানি পিছিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ ফাঁকা আদালত চত্বর দেখে, সেখানেই ঝিমিয়ে নিয়েছেন। কাজের চাপ নেই, ফলে আড্ডাও বসেছে। ওই এজলাসের পেশকার বললেন, ‘‘বিচারক সাহেব এজলাসে বসেছিলেন। আইনজীবীরা না থাকায় মামলার নথিতে সইসাবুদ সেরে চেম্বারে ফিরে গিয়েছেন।’’
সাতসকালে জেলবন্দি স্বামীর মামলার শুনানির জন্য শিয়ালদহ আদালতে হাজির হয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জহুরা বিবি। কিন্তু আদালতে এসে জানতে পারেন, আইনজীবীদের কর্মবিরতি চলছে বলে শুনানি হবে না। ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন তিনি। নোটারি হলফনামা তৈরি করতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও কার্যত বিফল মনোরথ হয়ে ফিরেছেন। মুহুরিরা জানিয়েছেন, নথিপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। তাঁরা টাইপ করে রাখবেন। সোমবার কর্মবিরতি উঠলে তা আইনজীবীদের স্বাক্ষর করিয়ে দেওয়া হবে। তবে একটু ঘুরপথেও ব্যবসা চলেছে। এ দিন এক মুহুরিকে একটু ‘অনুরোধ’ করতেই তিনি বললেন, ‘‘কাগজ জমা দিয়ে যান। রাতে দাদার (আইনজীবী) বাড়ি থেকে সই করিয়ে দেব।’’
ব্যারাকপুর আদালত
আদালত সমন পাঠিয়েছিল। পরিবারের দাবি সেই সমন বাড়িতে পৌঁছয়নি। ফলে পুলিশ বুধবার রাতে তুলে নিয়ে গিয়েছে তাঁর ভাইকে। বৃহস্পতিবার আদালতে তোলা হয়েছিল নিমতার পিয়া রায়ের ভাইকে। বৃহস্পতিবার ব্যারাকপুর আদালতে এসে কোনও আইনজীবী পাননি তিনি। ফলে ভাইয়ের জামিনের জন্য আবেদনই করা যায়নি। শুক্রবারও সকাল থেকে আদালতে এসে বসেছিলেন পিয়াদেবী। তিনি বলেন, ‘‘উকিলবাবুদের কাছে গিয়ে বারবার বলেছি। কিন্তু ওঁদের ধর্মঘট চলছে। কেউ রাজি হননি।’’ আদালতের বাইরের দোকানগুলি একেবারে ফাঁকা। ভিতরে আইনজীবীদের অধিকাংশ সেরেস্তাও খাঁ খাঁ করছে। বাকি সেরেস্তাগুলিতেও আইনজীবীদের আড্ডা চলছে। ভিতরের যে খাবারের দোকানগুলিতে অন্য দিন বসার ঠাঁই মেলে না, এ দিন দেখা গেল, সেগুলিও কার্যত মাছি তাড়াচ্ছে।
আদালত চত্বরে দেখা মিলল প্রচুর অসহায় মুখের। যেমন দমদমের বৃদ্ধ দম্পতি শশিকান্ত ও বেবিকা দত্ত। শরিকি বাড়ি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মামলা চলছে। এ দিন সেই মামলার শুনানি ছিল। কিন্তু শুনানি আর হয়নি। শশিকান্তবাবু বলেন, ‘‘এমনিতে তারিখের পর তারিখ পড়েই চলেছে। একটি দিন পিছিয়ে যাওয়া মানে আরও কত মাস যে পিছিয়ে গেল, কে জানে!’’
আরও অনেকেই এ দিন আদালতে এসেছিলেন। তারই মধ্যে এক আইনজীবীর দাবি, অনেকে জেনে যাওয়ায় এ দিন ভিড় কিছুটা কম ছিল। ব্যারাকপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের তরফে বলা হয়, ‘‘শনি এবং রবিবার ধর্মঘট নেই। এই দু’দিন জরুরি মামলা লড়া হবে। সোমবার ফের ধর্মঘট।’’
বারাসত আদালত
বারাসতের অনুপম হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য মনুয়া মজুমদারের মতো অনেক অভিযুক্তকেই এ দিন আনা হয়েছিল বারাসত জেলা
আদালতে। কিন্তু আইনজীবীদের বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির জেরে কোনও শুনানিই হল না। ভোগান্তি হল বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বিচারপ্রার্থীদের। আগামী সোমবারও এমন অচলাবস্থাই থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন আইনজীবীরা। ফলে অনেকেরই আশঙ্কা, কার্যত পাঁচ দিন আদালতের সমস্ত কাজকর্ম মুলতুবি হয়ে থাকবে।
এই আদালতে জেলা বিচারালয় ছাড়াও, ২২টির মতো বিচারালয় রয়েছে। আছে ক্রেতা সুরক্ষার মতো বিশেষ আদালত। রাজ্যের সমস্ত সাংসদ, বিধায়কদের বিরুদ্ধে মামলা এবং সারদা মামলার বিচার চলছে এখানে। প্রতিদিন দু’হাজারেরও বেশি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া চলে। এ দিন দেখা গেল, সে সব কাজই বন্ধ।
বিধাননগরের সাইবার ক্রাইম মামলায় দমদম সেন্ট্রাল জেলে রয়েছেন নিবাস মণ্ডল। তাঁর জামিনের আবেদনের জন্য এ দিন
ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া থেকে বারাসত আদালতে এসেছিলেন দাদা রঞ্জিত মণ্ডল। মামলা না হওয়ায় ফিরে যেতে হয় তাঁকে। রঞ্জিত বলেন, ‘‘এ সব গোলমালের কথা জানতাম না। এই গরমে এত দূর থেকে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে।’’ বনগাঁ থেকে আসা এক বিচারপ্রার্থীর অভিযোগ, ‘‘মাস খানেকের পরে আজ মামলার তারিখ পড়েছিল। ফের কবে আসতে হবে, তা-ও জানতে পারলাম না!’’
এই আদালতে আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ২২০০। বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির কথা উঠতেই বিভিন্ন আদালতের আইনজীবীদের পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, মক্কেলদের ফোন করে কর্মবিরতির খবর দেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণের হয়রানি যে কমেনি তাতে, তার প্রমাণ মিলল সবর্ত্রই।