কল্যাণীর সভাতেও তাঁরই নাম

ঠারেঠোরে সকলের মুখেই তাঁর কথা। কেউ বিঁধলেন, কেউ হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেন, কেউ বা হয়ে উঠলেন আরও আক্রমণাত্মক। তবে তাঁর নাম নিলেন না কেউই। সশরীর না থাকলেও নিজের খাসতালুক কল্যাণীতে রবিবার দলীয় সভায় সকলের মুখে প্রবল ভাবেই রয়ে গেলেন মুকুল রায়।

Advertisement

সুস্মিত হালদার ও সৌমিত্র সিকদার

কল্যাণী শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৫ ০৩:১১
Share:

রবিবার কল্যণীতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

ঠারেঠোরে সকলের মুখেই তাঁর কথা।

Advertisement

কেউ বিঁধলেন, কেউ হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেন, কেউ বা হয়ে উঠলেন আরও আক্রমণাত্মক। তবে তাঁর নাম নিলেন না কেউই। সশরীর না থাকলেও নিজের খাসতালুক কল্যাণীতে রবিবার দলীয় সভায় সকলের মুখে প্রবল ভাবেই রয়ে গেলেন মুকুল রায়।

জেলার যে সব তৃণমূল নেতা এত দিন মঞ্চে মুকুলবাবুর গা ঘেঁষে বসার জন্য হুড়োহুড়ি করতেন, এ দিন প্রায় তিন ঘণ্টার সভায় তাঁরাই মুকুলবাবুকে লক্ষ করে তির ছুড়ে গেলেন। এল অন্তর্ঘাতের প্রসঙ্গও। দীর্ঘদিনের প্রিয় নেতাকে এ ভাবে তিরবিদ্ধ হতে দেখে আক্ষেপ গোপন রাখেননি নিচুতলার অনেক তৃণমূল কর্মী-সমর্থকই।

Advertisement

কল্যাণী শিক্ষায়তনের মাঠে জেলা তৃণমূলের পক্ষ থেকে আয়োজিত এ দিনের সভার পোশাকি নাম ছিল ‘মিলনোৎসব’। সদ্য হয়ে যাওয়া উপনির্বাচনে দলের জয় উপলক্ষে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, কল্যাণী এবং হরিণঘাটা বিধানসভা এলাকার নেতা-কর্মীদের নিয়েই ওই আয়োজন। কয়েক মাস আগে এই কল্যাণীতেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার জন্য সব চেয়ে বেশি ছোটাছুটি করতে দেখা গিয়েছিল যাঁকে, সেই মুকুল রায়ই সেখানে নেই! “জানেন, এই প্রথম কল্যাণীতে কোনও সভায় রইলেন না দাদা।”আক্ষেপ করছিলেন এক তৃণমূল কর্মী। আক্ষরিক অর্থেই বুঝিয়ে দেওয়া হল, দলে মুকুল রায় ‘প্রাক্তন’। তাঁকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি বলে জেলা নেতৃত্বের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে।

এক দিন আগে, শনিবারই তৃণমূলে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘বক্সী-যুগ’। এ দিনের সভায় তাই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুকুলের স্থলাভিষিক্ত হওয়া সর্বভারতীয় তৃণমূল সম্পাদক সুব্রত বক্সী, দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সভার শুরু থেকেই দলে যে কোনও ফাটল নেই, তা প্রমাণে নেতারা মরিয়া ছিলেন। আর সে সব কথার ফাঁকে ফাঁকেই ঠারেঠোরে নাম না-করে এসেছে মুকুল-প্রসঙ্গ। মুকুলবাবু অবশ্য সে সব কথার কোনও গুরুত্ব দেননি।

সভার শুরুতেই পার্থবাবু তুলে ধরেন উপনির্বাচনে ওই তিন কেন্দ্রে অন্তর্ঘাত তত্ত্ব। তিনি বলেন, “আমি তো বলেছিলাম শাপলা ফোটাও, তার পর তো পদ্ম। এখানে শাপলাও তো ফোটাতে পারল না। তবে অন্তর্ঘাত হয়েছে। এখানকার বড়বাবুরা চেষ্টা করল অনেক। কিন্তু জনতা শেষ কথা প্রমাণ করে দিল।”

‘বড়বাবু’ বলতে পার্থবাবু যে মুকুলবাবুকেই ইঙ্গিত করেছেন, সে কথা সরাসরিই বলছেন নিচুতলার কর্মীরা। কেননা, উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই তিন কেন্দ্রে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের অন্দরে। সে ইঙ্গিত ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও। এ দিন জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তও জানান, কৃষ্ণগঞ্জ থেকে জেতা তাঁদের প্রার্থী সত্যজিৎ বিশ্বাসও ওই অভিযোগ জানিয়েছেন দলের কাছে।

দলের তরফে ওই তিন কেন্দ্রে ভোট দেখাশোনা করে থাকেন মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু। হরিণঘাটায় ভোট কম পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় শুভ্রাংশু গত লোকসভা ভোটে ভবানীপুর কেন্দ্রে দলের ভোট কম হওয়া নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তা নিয়ে দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে আলোচনাও হয়। যদিও ওই কমিটি এখনও শুভ্রাংশুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কিন্তু মুকুলবাবুকে ছেড়ে কথা বলছেন না নেতারা।

পার্থবাবুর কটাক্ষ, “আমরা কেউ কেউ শক্তিশালী বটে, তবে মূল হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সার্কাসের তাঁবুতে ছোট ছোট খুঁটি থাকে। তাদের একত্র করে রাখে মূল খুঁটি। আমরাও তাই। নেত্রী আমাদের একত্রিত করে রেখেছেন। অনেকেই তাঁকে আক্রমণ করেছেন, মিথ্যাচার করেছেন, জনমানসে হেয় প্রতিপন্ন করার পরিকল্পনা করেছেন। এখানেও তো কত রকমের উস্কানি ছিল।” এই ইঙ্গিতটাও যে স্পষ্ট তা মেনে নিয়েছেন উপস্থিত এক নেতা।

দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার সময় থেকেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল হয় মুকুলবাবু বিজেপিতে যোগ দেবেন, নয়তো নতুন কোনও মঞ্চ গড়বেন। মুকুলবাবু অবশ্য এখনও তেমন কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। তবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সহজে ফুরিয়ে যাবেন না। তাঁর নতুন কোনও পদক্ষেপে দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা যাতে প্রভাবিত না হন, সে জন্য তাঁদের ঐক্যবদ্ধ রাখারও চেষ্টা চালিয়েছেন পার্থবাবু। তাঁর কথায়, “আমরা কেউ একক ভাবে দল চালাতে পারব না। একসঙ্গেই কাজ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে আর ভুল বোঝাবুঝি নয়। একে অপরকে সন্দেহ করবেন না। এ ওখানে চলে গেল, সে সেখানে চলে গেল এ সব নিয়ে অহেতুক সন্দেহ করবেন না। সতর্ক থাকবেন কেউ যেন আঘাত করতে না পারে, পিছন থেকে টান দিতে না পারে, বদনাম করতে না পারে।”

‘মুকুলের লোক’ হিসেবে এক সময়ে পরিচিত গৌরীশঙ্কর দত্ত বা জেলা সভাপতি বাণী রায়ও সভায় ছিলেন। গৌরীবাবুও দাবি করেন, “উপনির্বাচনে দলের সর্বোচ্চ স্তর থেকে অন্তর্ঘাতের চেষ্টা হয়েছিল। দলের সাধারণ কর্মীরা রক্ষা করেছেন। যাঁরা অন্তর্ঘাতের চেষ্টা করেছেন তাঁদের দল থেকে বের করে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁরা নেতৃত্বে থাকবেন না। যাঁরা মাকে হত্যা করতে চায়, তাঁদের সে অধিকার নেই।” নাম না করলেও মুকুলবাবুকে তিনি আর নেতা বলেই মানেন না বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন গৌরীবাবু। তিনি বলেন, “বুথ স্তর থেকে সর্বত্র আমরা এক জনকেই মানি। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য কোনও হরিদাস পাল কর্মীদের আনুগত্য দাবি করতে পারেন না। তিনটি উপ-নির্বাচনে প্রমাণ করেছি। পুর নির্বাচনেও প্রমাণ করে দেব, নদিয়ার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি, ঠাঁই নাই দুর্বৃত্ত।”

দলের নতুন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রতবাবুকে অবশ্য এত কড়া কথা বলতে শোনা যায়নি। তিনি শুধু সমবেত ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন কর্মীদের। উপনির্বাচনে জেতার জন্য এ দিন বনগাঁয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টাকায় নেতাকর্মীরা ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে উপস্থিত থাকলেও মুকুল রায়কে নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে যান সুব্রতবাবু। মুকুলবাবু বনগাঁয় এলে যে উৎসাহ দেখা যায়, এ দিন সেই উৎসাহে অনেকটাই ঘাটতি দেখা গিয়েছে।

সহ-প্রতিবেদন: সীমান্ত মৈত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement