যেন দড়ির উপরে হাঁটা!
দেশ তথা বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল এই সময়ে আগামিকাল, শুক্রবার রাজ্য বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
গত বিধানসভা ভোটের আগে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ একগুচ্ছ কল্যাণ প্রকল্প চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবারের মহিলাদের হাতে প্রতি মাসে টাকা দেওয়া তো বটেই, তৃতীয় বার সরকার গড়ার পর থেকে তাঁর প্রশাসন জোর দিয়েছে ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘পড়ুয়া ঋণ কার্ড’, ‘দুয়ারে রেশন’-এর মতো সামাজিক প্রকল্পে। ভোটবাক্সে যে এর সদর্থক প্রভাব পড়ছে, এত দিনে বার বার তা কার্যত প্রমাণিত। কোভিডের ধাক্কায় বেসামাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যে এ ধরনের হাতে নগদ জোগানোর প্রকল্প প্রয়োজন, তা-ও বলেছেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে। কিন্তু বাজেটের মুখে প্রশ্ন হল, সরকারের নিজের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’ (রাজকোষ) এতগুলি কল্যাণ প্রকল্প চালানোর মতো টাকা আসবে কোথা থেকে? বিশেষত যেখানে আগের দু’দফার সরকারের চালু করা বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পও চালিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা রয়েছে। চিন্তা বাড়াচ্ছে রাজ্য-সহ সারা দেশে শিল্পে বড় অঙ্কের লগ্নির খরা আর রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা বিপুল ঋণের বোঝা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে জ্বালানি তেলের দর কত খানি বাড়বে, দুশ্চিন্তা তা ঘিরেও। কারণ, সে ক্ষেত্রে তার উপরে কর কমানোর চাপ বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
আর্থিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, গত এক বছরে রাজ্যের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও, আয়ের উৎস কার্যত সীমিত থেকে গিয়েছে। অথচ সামাজিক প্রকল্পে কাটছাঁট করা সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে গত বছর জুলাইয়ে পেশ করা বাজেটে মোট প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরে রেখেছিল রাজ্য। অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, ওই বরাদ্দ পুরো বছরের জন্য ছিল না। কিন্তু এ বার (২০২২-২৩ অর্থবর্ষে) খরচের পুরো ভারই বইতে হবে। ফলে প্রকল্পগুলির জন্য টাকার সংস্থান করা অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ।
একে দীর্ঘদিন রাজ্যে বড় বিনিয়োগ তেমন আসেনি। সারা দেশেও তা বাড়ন্ত। তার উপরে কোভিডের ধাক্কায় কার্যত কোমর ভেঙে গিয়েছে বহু ছোট-মাঝারি শিল্পের। তৃণমূল সরকার এই দফায় শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের উপরে জোর দেওয়ার কথা বলেছে। বিশেষত বড় শিল্পে বিনিয়োগ টানায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, যত দিন তা না হচ্ছে, তত দিন পর্যাপ্ত টাকা আসবে কোথা থেকে? সে ক্ষেত্রে ঋণের বোঝা আরও অনেকখানি বাড়বে না কি? প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে জানাচ্ছেন, লগ্নি টানার শর্ত হিসেবে পরিকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু সীমিত আয়ের মধ্যে বিপুল সামাজিক ব্যয়ের ধাক্কা সামলে পরিকাঠামোয় কতটা নজর দেওয়া যাবে, তা নিয়ে জল্পনা বিস্তর। প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকে মনে করছেন, সামাজিক এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্য রাখায় নজর দিতেই হবে রাজ্যকে। নইলে যথেষ্ট লগ্নি আসবে না। টান পড়বে রাজস্বে। আর সেই সূত্রে কঠিন হবে সামাজিক প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া।
গত জুলাইয়ের বাজেটে পূর্বাভাস ছিল, ২০২১-২২ সালে রাজ্যের কর আদায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে। আবগারি বাবদ আয়ও গতবারের তুলনায় কয়েক হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধির সম্ভাবনা। বেশ কয়েক মাস ধরে তেলের দাম আগুন। ফলে তার থেকে আদায় হওয়া করের অঙ্কও প্রাথমিক অনুমানের তুলনায় বেশ কিছুটা বাড়বে। এর উপরে কেন্দ্রীয় করের ভাগ ও অনুদান, জিএসটি আদায় ইত্যাদি যোগ করে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির অঙ্ক গত বছরের (প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা) তুলনায় কিছুটা বেড়ে ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা হতে পারে বলে আশা করছে রাজ্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্যয় যে হারে বাড়ছে, তাতে এই আয় যথেষ্ট কি? বিশেষত যেখানে ২০২১-২২ সালে শুধু রাজস্ব খাতে সম্ভাব্য ব্যয়ই ধরা হয়েছিল ২.১৩ লক্ষ কোটি টাকা।
বাজার থেকে আরও ধার নেওয়ার ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছিল রাজ্য। সে ক্ষেত্রে সুদে-আসলে বিপুল টাকা মেটাতে হবে। তা ছাড়া বেতন, পেনশন ইত্যাদি খাতে বড় অঙ্কের টাকা ধরে রাখতেই হবে। তার উপরে সামাজিক প্রকল্পে বরাদ্দ। এই সমস্ত প্রকল্প দীর্ঘ মেয়াদে সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যেতে আয় বাড়ানোর পথ খোঁজা ছাড়া যে উপায় নেই, তা মানছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। প্রশ্ন উঠছে, চড়া তেলের দর আর আবগারি সূত্রে আসা মোটা রাজস্ব না থাকলে, এই বিপুল খরচ সামাল দেওয়া যেত কী ভাবে?
প্রাক্তন এক অর্থ-কর্তার কথায়, “দেশে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার পৌঁছেছে প্রায় ১৪ শতাংশে। খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হারও ৬ শতাংশের আশেপাশে। এই বিষয়টি ভুললে চলবে না।” অর্থাৎ, বৃদ্ধির হার কিংবা বরাদ্দ বা আয় বৃদ্ধির প্রকৃত হিসাব করতে হবে এই হারের কথা মাথায় রেখে। রাজ্যের অবশ্য দাবি, ২০১১ সালে রাজ্যের যে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল (প্রায় ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা), তা ২০২১ সালে হয়েছে প্রায় ১৩.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে রাজ্যের অর্থনীতির অগ্রগতির ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হতে পারে বাজেটেও।