কল্যাণী পুরসভার ক্ষেত্রে আবেদনপত্রের ৯ নম্বরে লেখা হয়েছে, ‘নাগরিকত্বের প্রমাণ’। —নিজস্ব চিত্র।
নাগরিকত্ব ইস্যুতে তোলপাড় গোটা দেশ। তোলপাড় ‘কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’ স্লোগানকে ঘিরে। নাগরিকত্বের প্রমাণ কেন দিতে হবে, সেই প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার তোপ দাগছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মমতার রাজ্যেই জন্মের শংসাপত্র পেতে অভিভাবকের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে। জন্মের শংসাপত্র পেতে কল্যাণী পুরসভার যে ছাপানো আবেদনপত্র রয়েছে, সেখানেই লেখা রয়েছে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার কথা। আর তা নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র কাজ যখন শুরু হয়, সেই সময় থেকে এ রাজ্যেও জন্মের শংসাপত্র পেতে ভিড় বাড়তে থাকে পুরসভা এবং পঞ্চায়েতগুলিতে। সেই শংসাপত্র পাওয়ার জন্য পুরসভাগুলির নিজস্ব আবেদনপত্র রয়েছে। কল্যাণী পুরসভার ক্ষেত্রে ওই আবেদনপত্রের ৯ নম্বরে লেখা হয়েছে, ‘নাগরিকত্বের প্রমাণ’। পুত্র বা কন্যার নাম, জন্ম তারিখ, জন্মস্থান, বাবা এবং মায়ের নাম, ঠিকানা, তাঁদের বর্তমান-সহ জীবিত সন্তানের সংখ্যা যেমন জানতে চাওয়া হয়েছে ওই আবেদনপত্রে, তেমনই হাসপাতাল, নার্সিংহোম বা নিজের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করার প্রমাণপত্রের সঙ্গে লাগবে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্রও।
প্রশ্ন উঠছে, যেখানে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রোজ তোপ দাগছেন মমতা, কেন নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, সেখানে কী ভাবে রাজ্যের একটি পুরসভা নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইছে? মানবাধিকার সংগঠনগুলি এ নিয়ে সরবও হয়েছে। রাজ্যের অন্য কোনও পুরসভায় এমন ভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে কি না, তা যদিও এখনও জানা যায়নি। তবে জন্মের প্রমাণপত্র পেতে কলকাতা এবং হাওড়া পুরসভার যে আবেদনপত্র রয়েছে, সেখানে কিন্তু এই ‘নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র’ জমা দেওয়ার বিষয়টি নেই।
আরও পড়ুন: ‘পরিকল্পিত গণহত্যা হয়েছে দিল্লিতে’, নেতাজি ইন্ডোরের মমতা
হাওড়া ও কলকাতা পুরসভার আবেদনপত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণ চাওয়া হয় না।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান সুশীলকুমার তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘অন্য পুরসভায় কী হয় আমার জানা নেই। নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র বলতে, যিনি আবেদন করছেন, তিনি যে কল্যাণী পুর এলাকার বাসিন্দা, তার প্রমাণপত্র চাই আমরা। পুরসভার কোনও কাউন্সিলর ওই ব্যক্তিকে বসবাসের শংসাপত্র দিলেই কাজ মিটে যাবে।’’
তবে, কলকাতা পুরসভার এক আধিকারিক কল্যাণীর চেয়ারম্যানের ওই যুক্তি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের অধীনে রয়েছে সব পুরসভা। সকলের ক্ষেত্রে তো একই নিয়ম। কলকাতার ক্ষেত্রে এক, আর কল্যাণীর ক্ষেত্রে আর এক, এটা হয় নাকি! কলকাতায় কোনও শিশু জন্মালে তার অভিভাবকের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয় না। তা হলে কল্যাণীর ক্ষেত্রে কেন দিতে হবে?”
কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান সুশীলকুমার তালুকদার আরও বলছেন, ‘‘আমাদের সরকার তো বার-বার বলছে, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যে কোনও নথিই নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র। সে ক্ষেত্রে সচিত্র ভোটার কার্ড থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের ঠিকানার কোনও নথি দিলেই তাঁর সন্তানের জন্মের শংসাপত্র মিলবে। এ নিয়ম তো আগেও ছিল। অহেতুক এর মধ্যে কেউ-কেউ অন্য গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘এই আবেদনপত্র তৃণমূল আমলে ছাপানো হয়নি। বাম আমল থেকেই এই ভাষায় লেখা চলছে।’’
যদিও সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেছেন, ‘‘সিপিএমও এক সময় পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় জন্মের শংসাপত্রের জন্য এমন নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি চাওয়া হয়নি। আসলে বিজেপির যে ভাবে নাগরিকত্বকে দেখতে চাইছে তৃণমূল সেটাই কার্যকর করছে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সাল থেকে এই পুরসভা তৃণমূলের হাতে আসে। তার আগে বাম নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় চেয়ারম্যান ছিলেন শান্তনু ঝা। তাঁর কথাতেও, ‘‘আমাদের সময় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র চাওয়া হত না বা ফর্মে লেখাও থাকত না। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপির এজেন্ডা তৃণমূল পালন করছে।’’ অন্য দিকে, বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মন্তব্য, ‘‘দেরিতে হলেই তৃণমূল নাগরিকত্বের মর্যাদা বুঝেছে। তাই আবেদনপত্রে নাগরিত্বের প্রমাণপত্র দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।’’
রাজ্যের পুরসভাগুলিতে নিয়মের হেরফের যদিও এই প্রথম নয়। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশিকা উপেক্ষা করে রাজ্যের দুই পুরসভায় জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। কর্তব্যে ‘বিচ্যুতি’র কারণে উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটি এবং টিটাগড় পুরসভার সংশ্লিষ্ট আধিকারিকরা কড়া শাস্তির মুখেও পড়েন সে বার।
আরও পড়ুন: জামিন হল না ‘গোলি মারো’ স্লোগান দিয়ে ধৃত বিজেপি কর্মীদের ২ জনের
কল্যাণী পুরসভা থেকে জন্মের শংসাপত্র আনতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এমনটাই অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর। সংগঠনের সদস্য আলতাফ আহমেদ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন, তাঁরা সন্তানের জন্মের শংসাপত্র পেতে পুরসভায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের মনে হচ্ছে, এই আবেদনপত্রের সঙ্গে এনআরসি এবং এনপিআরের যোগ রয়েছে। ওই পুরসভা সুকৌশলে এবং ঘুরপথে নাগরিকত্বের প্রমাণ নিতে চাইছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘রাজ্যের এক এক পুরসভায় এক এক রকমের নিয়ম হতে পারে না।’’
এ বিষয়ে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, তিনি ফোন ধরেননি। জবাব দেননি হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজেরও।