সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের সংখ্যালঘু মহল্লায় কেমন ভোট পেল শাসক তৃণমূল? — ফাইল চিত্র।
আনিস খানের মৃত্যু, বগটুইয়ে ১০ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক তথা ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা নওশাদ সিদ্দিকির ৪১ দিন জেলবন্দি থাকা— বিভিন্ন টুকরো ঘটনায় কি শাসক তৃণমূলের জনসমর্থনের অন্যতম ভিত্তি সংখ্যালঘু ভোটে ক্ষয় হচ্ছে? মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের কাছে তৃণমূলের হারের পর এমন একটা ‘ধারণা’ তৈরি হচ্ছিল। অনেকেই বলছিলেন, তৃণমূলের ‘মজবুত’ ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। মুখ ফেরাচ্ছেন সংখ্যালঘুরা।
খানিকটা উদ্বেগ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল বইকি! সাগরদিঘির পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে তিনি সংখ্যালঘু মন্ত্রীদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছিলেন। যদিও দল হিসেবে তৃণমূল কখনওই এ নিয়ে প্রকাশ্যে বেশি উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা দেখায়নি। বরং বলেছিল, ‘‘সাগরদিঘি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাংলার সংখ্যালঘুদের নিরাপদ আশ্রয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।’’ পঞ্চায়েত ভোটে বাংলার সেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে কেমন ফল হল ত়ৃণমূলের? উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ— জেলা ধরে সংখ্যালঘু এলাকার ভোটের ছবির তথ্যানুসন্ধান করল আনন্দবাজার অনলাইন।
উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর
দুই দিনাজপুরে সংখ্যালঘু অধুষ্যিত এলাকার মধ্যেও ভাষাগত বৈচিত্র রয়েছে। দক্ষিণের ইটাহারে যেমন বাংলাভাষী মুসলিমরা রয়েছেন, তেমনই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং ইসলামপুরে উর্দুভাষী সংখ্যালঘুদের আধিক্য। পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গিয়েছে, এই সমস্ত এলাকাতেই তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছে। ইসলামপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল করিম চৌধুরী বিদ্রোহের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। ফলে দুই দিনাজপুরের সংখ্যালঘু এলাকার ফল নিয়ে খুশি তৃণমূল। অখুশি হওয়ার মতো কোনও সূচক পঞ্চায়েত ভোটে দেখা যায়নি।
মালদহ
গোটা জেলার সর্বত্রই ছড়িয়েছিটিয়ে সংখ্যালঘুদের বাস থাকলেও মূলত হরিশ্চন্দ্রপুর, রতুয়া, চাঁচলের দু’টি করে ব্লক ও কালিয়াচক ১ নম্বর ব্লকে সংখ্যালঘুদের আধিক্য রয়েছে। এই সমস্ত এলাকায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোট ফলাফলের চিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখা যাচ্ছে— গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূল নিরঙ্কুশ না হলেও পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে হাসতে হাসতে জয় হাসিল করেছে শাসকদল। হরিশচন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকে মোট সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত। এর মধ্যে একটি জিতেছে তৃণমূল, একটি কংগ্রেস। বাকি পাঁচটি ত্রিশঙ্কু। আবার এই ব্লকেই মোট তিনটি জেলা পরিষদের আসন। এর মধ্যে দু’টি পেয়েছে তৃণমূল। একটি কংগ্রেস। মালদহ এককালে কংগ্রেসের ‘গড়’ বলেই পরিচিত ছিল। সৌজন্যে প্রয়াত বরকত গনি খান চৌধুরী। কিন্তু কালে কালে তার ক্ষয় হয়েছে। এমনকি, কোতোয়ালির গনি পরিবারেও থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। মৌসম বেনজির নুর এখন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ। যদিও দেখা যাচ্ছে, মালদহ জেলা পরিষদে কংগ্রেস যে পাঁচটি আসন পেয়েছে, তার সবক’টিই এই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা থেকে। যা লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের কাছে ‘রুপোলি রেখা’র আভাস বলে তারা মনে করছে।
মুর্শিদাবাদ
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলাকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ‘অভিমুখ’ করেছিল কংগ্রেস-বাম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কার্যত মাটি কামড়ে পড়েছিলেন জেলায়। সমগ্র পঞ্চায়েত পর্বে হিংসা এবং খুনের ঘটনার নিরিখে মুর্শিদাবাদ এ বারেও ‘ব্যতিক্রম’ হতে পারেনি। ফলাফলে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের একচেটিয়া আধিপত্য। গ্রাম পঞ্চায়েতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু আসন জিতলেও পরিসংখ্যান বলছে, বাম-কংগ্রেস তেমন কোনও লড়াই দিতে পারেনি। জেলা পরিষদের মোট আসন ৭৮টি। একা তৃণমূলই পেয়েছে ৭২টি। চারটি কংগ্রেস, দু’টি সিপিএম। যদিও বাম-কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, ‘‘এটা লুটের জয়। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নয়।’’
নদিয়া
জেলার যে যে ব্লকে সংখ্যালঘু জনঘনত্ব রয়েছে, সেখানে পঞ্চায়েতের ফল একমুখী নয়। বরং জনমতের মিশ্র প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। যেমন করিমপুর ব্লকে তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেসের ভোট কাছাকাছি জায়গায়। জোটের ভোট আগের থেকে বেশ খানিকটা বেড়েছে। যার ফলে গ্রাম পঞ্চায়েতে আসন জেতার ক্ষেত্রে করিমপুরে ‘ছাপ’ রেখেছে বাম-কংগ্রেস। আবার চাপড়া, কালীগঞ্জে আগের থেকে ভোট কমে গিয়েছে তৃণমূলের। নাকাশিপাড়াতেও বাম-কংগ্রেসের উত্থান চোখে পড়ার মতো। যদিও সার্বিক ভাবে জেলা পরিষদ দখল বা পঞ্চায়েত সমিতি গঠনের ক্ষেত্রে তৃণমূলকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সংখ্যালঘু মহল্লায় তৃণমূলের ভোট হ্রাস ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন অনেকে।
বীরভূম
বাংলার রাজনীতিতে বীরভূমের অন্যতম পরিচয় ‘অনুব্রত মণ্ডলের জেলা’। জেলা সভাপতি অনুব্রত এখন জেলবন্দি থাকলেও তাঁর উত্তরসূরিরা ‘দাদার কায়দায়’ ভোট করিয়ে দাপটের সঙ্গে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই একাধিপত্য কায়েম রেখেছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তিনটি এলাকা নানুর, মুরারই এবং নলহাটির ফল ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। নানুর থেকে জেলা পরিষদে জিতেছেন কাজল শেখ। একদা কেষ্ট-বিরোধী কাজলের এ বারই প্রথম ভোটে জেতা। গোটা নানুরেই তৃণমূল বিপুল ভোট পেয়ে জিতেছে। কিন্তু মুরারই এবং নলহাটিতে কিছুটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে বাম-কংগ্রেস। চারটি পঞ্চায়েত দখল করেছে তারা। এই এলাকা থেকে একটি জেলা পরিষদের আসনও জিতেছে কংগ্রেস। আবার দগ্ধ বগটুইয়ে তৃণমূল নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান
শস্যগোলা পূর্ব বর্ধমানের সর্বত্রই সংখ্যালঘুদের বাস। কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ব্লক বলতে মূলত ভাতার, খণ্ডঘোষ, গলসি (২), মেমারি (২), কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট। ইতিউতি সিপিএম-কংগ্রেস গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে কিছু আসন পেলেও তা হিসাবে ধরার মতো নয়। তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, পূর্ব বর্ধমানের সংখ্যালঘু এলাকার ভোট নিয়ে তৃণমূলের খুব একটা মাথাব্যথার কারণ নেই।
হুগলি
চণ্ডীতলা, জাঙ্গিপাড়া, পাণ্ডুয়ার বড় অংশে এবং খানাকুল, পুরশুড়া ও আরামবাগের একাংশে সংখ্যালঘুদের বাস। সেই সমস্ত এলাকার ফল নিয়ে তৃণমূলকে ‘অভ্যন্তরীণ ময়নাতদন্ত’ করতে হতে পারে বলে জেলারই অনেক নেতা মনে করছেন। তার মধ্যে অন্যতম পাণ্ডুয়া এবং খানাকুল। পাণ্ডুয়ায় তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছে সিপিএম। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সঞ্জয় ঘোষ পঞ্চায়েত সমিতিতে পরাস্ত হয়েছেন সিপিএমের কাছে। আবার সংখ্যালঘু ভোট ‘ফ্যাক্টর’ থাকা খানাকুল ২ পঞ্চায়েত সমিতি জিতেছে বিজেপি। এমনকি, এই এলাকা থেকে দু’টি জেলা পরিষদের আসনেও পদ্ম ফুটেছে। জাঙ্গিপাড়ার মধ্যে ফুরফুরা পঞ্চায়েতের ফল নিয়ে মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্টে। সিপিএম এবং আইএসএফের দাবি, ২৮-১ ব্যবধানে তারা পঞ্চায়েত দখল করেছে। কিন্তু গণনাকেন্দ্রে বিডিও, তৃণমূল এবং পুলিশ মিলে ফল ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই পঞ্চায়েতের ফল নওশাদ সিদ্দিকির কারণেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আরামবাগ লোকসভায় হাজারখানেক ভোটে জিতেছিলেন তৃণমূলের অপরূপা পোদ্দার। তার পর ২০২১ সালের বিধানসভায় গোটা আরামবাগ মহকুমায় ‘শূন্য’ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল। লোকসভা ভোটের এক বছরও যখন বাকি নেই তখন খানাকুলের ফল তৃণমূলের জন্য ‘উদ্বেগ’ তৈরি করতে পারে।
হাওড়া
হুগলিতে সংখ্যালঘু এলাকায় তৃণমূলের ফল কিছুটা উদ্বেগজনক হলেও পাশের জেলা হাওড়ায় তা নয়। আমতা, উদয়নারায়ণপুর, উলুবেড়িয়া, বাঁকড়া এক ও দু’নম্বর ব্লক, পাঁচলা, জগৎবল্লভপুর— সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সর্বত্রই তৃণমূল জিতেছে। শুধু জয় নয়, বড় ব্যবধানে জিতেছে তারা। হাওড়ার সংখ্যালঘু এলাকার ফলাফল তৃণমূলকে স্বস্তিতে রাখবে।
উত্তর ২৪ পরগনা
এই জেলার সংখ্যালঘু মহল্লা বলতে সমগ্র বসিরহাট মহকুমা, দেগঙ্গা এবং আমডাঙা বিধানসভা। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে এমন কোনও ফল হয়নি, যা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা দেখা যাবে। বরং লোকসভা ভোটে বসিরহাটে ব্যবধান নিয়ে চর্চা করতে পারে শাসকদল। এই সব এলাকায় পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই দাপট রয়েছে তৃণমূলের।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা
বাংলার রাজনীতিতে এই জেলা এখন নানা কারণে অন্যতম আলোচনার বিষয়। এক, ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই, ভাঙড়ে আইএসএফের লড়াই ও নওশাদ সিদ্দিকি। সংখ্যালঘু মহল্লার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্যতম এলাকা ভাঙড়ের দু’টি ব্লক, ক্যানিং পূর্ব, মগরাহাট পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভা, ডায়মন্ড হারবার এবং কুলপি। ভাঙড়ের ১ নম্বর ব্লক আগেই জিতেছিল তৃণমূল। ভাঙড়ের ২ নম্বর ব্লকে লড়াইয়ের মুখে পড়তে হয় শাসকদলকে। তা ছাড়া কুলপিতে আইএসএফ কিছুটা মাথাচাড়া দিয়েছে এই ভোটে। এ ছাড়া দক্ষিণের সংখ্যালঘু মহল্লায় তৃণমূল তেমন কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে যেতে শুরু করেছিল। ২০০৯ সালে তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। তার পরে যত সময় গিয়েছে ততই সংখ্যালঘু মহল্লায় সাংগঠনিক ভিত মজবুত করেছে তৃণমূল। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় অনেকেই অনুমান করছিলেন, সেই ভোট তৃণমূল ধরে রাখতে পারবে কিনা। তবে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল বলছে, কিছু জেলার কিছু এলাকায় এখনও পর্যন্ত তৃণমূলকে সংখ্যালঘু সমর্থন নিয়ে চিন্তার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।