মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
এক দিকে প্রশাসন। অন্য দিকে দল। ‘জোড়া অস্ত্রে’ সন্দেশখালির ‘ক্ষত’ মেরামতি শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই তৃণমূলের প্রতিনিধি দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে সন্দেশখালির সাধারণ বাসিন্দাদের ক্ষোভ-অভিযোগের কথা শুনছিল। ‘দুয়ারে সরকার’-এর ধাঁচে রবিবার থেকে সেখানে শিবির বসিয়েছে প্রশাসন। দিনের শেষে সেই শিবিরেও জমা হল অন্তত ৪০০টির মতো অভিযোগ। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, এই ধরনের শিবির চলতেই থাকবে সন্দেশখালিতে।
শাহজাহান শেখ, তাঁর শাগরেদ উত্তম সিংহ ও শিবপ্রসাদ হাজরা (শিবু)দের বিরুদ্ধে জমি দুর্নীতি ও মহিলাদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে গত সপ্তাহে উত্তাল হয়েছিল সন্দেশখালি। দফায় দফায় হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। তার পর থেকেই সন্দেশখালির ‘ক্ষোভ প্রশমনে’ নেমেছে তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে উত্তমকে দল থেকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। রে়ড রোডে তৃণমূলের ধর্নামঞ্চ থেকে তা ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। তার পরেই উত্তমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার শিবুও গ্রেফতার হন। রবিবার সেই পার্থ ও রাজ্যের আরও দুই মন্ত্রী সুজিত বসু এবং বিরবাহা হাঁসদা সন্দেশখালি যান। এলাকায় ঘুরে ঘুরে তৃণমূলের মার্চ মাসের সভার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন। এলাকায় যাঁদের জমির লিজ়ের টাকা ফেরত পাওয়ার কথা, রবিবার সেই কাজও শুরু হয়েছে পার্থদের হাত ধরে। ঘটনাচক্রে, বীরভূমের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, সন্দেশখালিতে কেউ কিছু নিয়ে থাকলে, তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর কথায়, ‘‘মনে রাখবেন, আমি যখন যেটা বলি, তখন সেটা করি।’’
সন্দেশখালিতে বিক্ষোভ আছড়ে পড়ার পর গত মঙ্গলবার সন্দেশখালি গিয়ে এলাকা ঘুরে পার্থ স্বীকার করেছিলেন, গত দু’বছর ইজারার টাকা, ভেড়ির টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আছে। যাঁদের টাকা ফেরত পাওয়ার কথা, তাঁদের টাকা ফেরত দেবে দল। সেই মতো স্থানীয় ভাবে একটি কমিটিও গঠন করেছিল তৃণমূল। দলীয় সূত্রে খবর, সেই দলে রয়েছেন সন্দেশখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান গণেশ হালদার, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য অষ্টমী সর্দার এবং তৃণমূলের এসসি-এসটি-ওবিসি সেলের নেতা মহেশ্বর সর্দার। পার্থের ঘোষণার পরেই তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেন গত কয়েক দিন ধরে। কারা জমির লিজ়ের টাকা পাননি, তার তালিকা তৈরি করেছেন। এর পর রবিবার থেকে টাকা ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছে। পার্থ জানিয়েছেন, চাঁদা তুলে টাকা মেটানো হচ্ছে।
তৃণমূল সূত্রে খবর, যাঁদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে রবিবার, তাঁদের মধ্যে চার জন হলেন—মায়া চক্রবর্তী, জ্যোৎস্নাবালা মণ্ডল, অংশুমান সর্দার এবং সিদাম মণ্ডল। মায়া আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘উত্তম সর্দারের কাছ থেকে টাকা পেতাম। আজ মন্ত্রীরা এসে টাকা দিয়ে গেলেন। কাগজপত্র দেখল। ওরা বলল, আর যা পাওনা আছে জমি ঠিক করে মেপেজুকে দেখে সেই মতো টাকা পাঠিয়ে দেবে। আরও অনেককে টাকা দিয়েছে। কমবেশি অনেকেই পেয়েছে।’’
শুধু ক্ষোভ প্রশমনই নয়, লোকসভা নির্বাচনকে নজরে রেখে এলাকায় সংগঠনেও নজর দিয়েছে শাসকদল। সুজিত সংবাদমাধ্যমে জানান, শিবু সন্দেশখালি ২ ব্লকের সভাপতি। এখন থেকে তাঁর এলাকায় সংগঠন দেখবেন সন্দেশখালির তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতো। গত সপ্তাহে দফায় দফায় হিংসার ঘটনায় শাহজাহান শেখের ‘শাগরেদ’ শিবু ও উত্তম সর্দারের নাম জড়িয়েছিল। তার পরেই উত্তমকে দল থেকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করে তৃণমূল। তার পরেই উত্তমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু শিবুর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি দলের তরফে। শনিবার সেই শিবু গ্রেফতার হওয়ার পরেই এলাকায় সংগঠনে নজর দিতে শুরু শাসকদল। সুজিত বলেন, ‘‘শিবপ্রসাদের এলাকায় দলের সংগঠন দেখবেন সন্দেশখালির বিধায়ক সুকুমার মাহাতো।’’ শিবুর বিরুদ্ধে দল কোনও পদক্ষেপ করবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘‘শিবপ্রসাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।’’ তৃণমূল সূত্রে খবর, ধৃত উত্তমের এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নেতা গৌর রায়কে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপও শুরু হয়েছে সন্দেশখালিতে। রবিবার সন্দেশখালির দু’টি ব্লকে মোট সাতটি শিবির খোলা হয়েছিল। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, সেই সব শিবিরে জমি সংক্রান্ত অভিযোগ তো রয়েছেই, রয়েছে বার্ধক্য ভাতা ও বিধবা ভাতা সংক্রান্ত অভিযোগও। সকাল থেকেই সেই শিবিরগুলিতে ভিড় চোখে পড়ার মতো ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে হোর্ডিং-এ লেখা রয়েছে, ‘পরিবর্ধিত সমস্যা সমাধান জনসংযোগ’। বসিরহাট মহকুমা আধিকারিকের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্দেশখালি ১ ব্লকে জমা পড়েছে ৯০টি অভিযোগ। তার মধ্যে জমি সংক্রান্ত অভিযোগ আটটি। আর সন্দেশখালি ব্লকে সব মিলিয়ে ৩২০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে ৪০টির মতো জমি সংক্রান্ত অভিযোগ। বাকিগুলির মধ্যে বার্ধক্য ও বিধবা ভাতা সংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, শাহজাহান, উত্তম ও শিবুদের নামে শ’য়ে শ’য়ে অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসীরা। তার মধ্যে অন্যতম হল জমি কেড়ে নিয়ে ভেড়ি করা এবং পাট্টা না দেওয়া। ওই সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখতেই শিবির শুরু হয়েছে।
সন্দেশখালি-প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী
সন্দেশখালির ঘটনা ‘তিলকে তাল’ করে দেখানো হয়েছে। প্রথমে ইডি এবং পরে তাদের ‘বন্ধু’ বিজেপি গিয়ে সেই গোলমালে ইন্ধন দিয়েছে। এমনটাই অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার বীরভূমের সিউড়িতে প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে সন্দেশখালি নিয়ে আবারও কেন্দ্রের শাসকদলকে কাঠগড়ায় তোলেন মমতা। ইডি এবং বিজেপি যে এই ঘটনায় যুক্ত, সে কথাও উঠে এসেছে তাঁর বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘‘সন্দেশখালিতে একটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা ঘটানো হয়েছে। প্রথমে ইডি-কে পাঠিয়েছে। তার পর তাদের বন্ধু বিজেপি ঢুকেছে। তিলকে তাল করা হয়েছে। শান্তির পরিবর্তে আগুন লাগাচ্ছে। আমি অফিসার পাঠাব, যার যা অভিযোগ আছে, বলবেন। কেউ যদি কিছু নিয়ে থাকে, সব ফেরত দেওয়া হবে।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা কোনও অভিযোগ করেননি। আমি পুলিশকে বলি, স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পদক্ষেপ করতে। আমাদের ব্লক প্রেসিডেন্ট গ্রেফতার হয়েছেন। আমি কিছু বললে, করে দেখাই। ভাঙড়ে আরাবুলও তো গ্রেফতার হয়েছে। ও তো আমাদের কর্মী! তোমরা কত জনকে গ্রেফতার করেছ?’’ গত ৫ জানুয়ারি শাহজাহান শেখের বাড়িতে ইডির তল্লাশি করতে যাওয়া এবং আধিকারিকদের আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আর দেখা মিলছিল না তাঁর। শিবু হাজরা তার পর থেকে অধরা ছিলেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি শিবু, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগে গর্জে ওঠে সন্দেশখালি। ভাঙচুর চলে জেলা পরিষদের সদস্য তথা তৎকালীন অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি উত্তমের বাড়িতে। পরদিন ভাঙচুর চলে শিবুর বাগানবাড়ি এবং মুরগির খামারে। আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই শিবুকে ১০ দিনের হেফাজতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ। তবে সন্দেশখালির মহিলারা বলছেন, তাঁরা শাহজাহানের গ্রেফতারির অপেক্ষায়। নিজের প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে সিউড়ির সভায় মমতা বলেন, “আমি পুলিশের টিম পাঠাব। যা অভিযোগ তাঁদের বলবেন। আমাদের ব্লক প্রেসিডেন্টরা অ্যারেস্ট হয়েছেন। কোনও অভিযোগ হয়নি। আমি সুয়োমোটো করতে বলেছি। আমি কি পারি না গদ্দারদের অ্যারেস্ট করতে ! একটু ছাড় দিয়ে রেখেছি।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘একটু সময় দিচ্ছি। সুতো ছাড়ছি। গদ্দারদের সব চুরি, দুর্নীতির মামলা... সবাইকে বলে চোর। ওরা চোরেদের ঠাকুরদা। মায়েরা বলেন, শূন্য কলসি বড্ড বাজে বেশি। এরা হচ্ছে শূন্য কলসি। কিচ্ছু নেই। দিল্লি ‘হ্যাঁ’ বললে ধিতাং ধিতাং বলে নৃত্য করে। ‘না’ বললে মনখারাপ করে ঘরে বসে থাকে। দিল্লির দয়ায় রাজনীতি করে। বাংলাকে ভালবাসে না। এরা বাঙালিবিরোধী, মহিলাবিরোধী, দলিতবিরোধী, কৃষকবিরোধী।’’
মিষ্টি বিতরণ সন্দেশখালিতে
তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবু গ্রেফতার হয়েছেন শনিবার। রবিবার তাঁকে আদালতে হাজির করানোর সময় উঠল ‘চোর-চোর’ স্লোগান। অন্য দিকে তৃণমূল নেতার গ্রেফতারি ‘উপলক্ষে’ তখন সন্দেশখালির রাস্তায় রাস্তায় নেমে মিষ্টি বিতরণ করলেন মহিলারা। কেউ বললেন, ‘‘এ বার শান্ত হবে এলাকা। শুধু শাহজাহান বাকি। তার পর তো পুরো শান্তি।’’ কেউ বললেন, ‘‘আদালতে না, ওকে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হোক।’’ আবার কেউ চিৎকার করলেন ‘রেপিস্ট’ বলে। বিলি হওয়া গরম জিলিপিতে কামড় বসিয়ে এক মহিলার ঘোষণা, ‘‘এ বার তো শুধু মিষ্টিমুখ হল। শাহজাহান ধরা পড়লেই পিকনিক হবে।’’
১৪৪ ধারা প্রত্যাহার
এলাকাভিত্তিক পর্যালোচনা করে সন্দেশখালি থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের ভাবনাচিন্তা রয়েছে বলে শনিবার জানিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। তার পরেই রবিবার সন্দেশখালির পাঁচটি এলাকা থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল প্রশাসন। অন্য দিকে, সন্দেশখালিকাণ্ডে ধৃত তৃণমূল নেতা শিবপ্রসাদ হাজরাকে ৮ দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে বসিরহাট মহকুমা আদালত। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, গত মঙ্গলবার বসিরহাট মহকুমা সন্দেশখালির মোট ২০টি জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। তার মধ্যে দাউদপুর, আতাপুর, কুলেপাড়া ও গোপালের ঘাট এলাকা থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হল। রবিবার বিকেল ৪টে থেকে ওই চার এলাকায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে।