—প্রতীকী ছবি।
ক্রিকেটের পরিভাষায় বলে স্লগ ওভারে ঝোড়ো ব্যাটিং। পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের শেষ পর্বে অবিকল যেন সেই দৃশ্য! মনোনয়নের প্রথম চার দিনে যে শাসক দল ছিল বিরোধীদের চেয়ে পিছিয়ে, শেয দু’দিনে গতি বাড়িয়ে পঞ্চায়েতের মোট আসনের চেয়ে অনেক বেশি মনোনয়ন জমা দিয়ে ফেলল তারা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সরকারি ভাবে শেষ ৮ ঘণ্টায় শুধু শাসক দলেরই মনোনয়ন জমা পড়ল ৭৪ হাজারের বেশি!
এই দ্রুত মনোনয়নের প্রক্রিয়ার মধ্যেই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে বিরোধীরা। বলা হচ্ছে, ‘মনোনয়ন ম্যাজিক’। উঠতে শুরু করেছে তদন্তের দাবিও। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য পাল্টা বলছে, তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার জেরে যে কাজ তারা করতে পেরেছে, বিরোধীদের সেই ক্ষমতা নেই বলেই তারা অনর্থক ‘চক্রান্তে’র তত্ত্ব খাড়া করছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, ‘নির্দল-কাঁটা’ যথাসম্ভব কমাতে দেরিতে প্রার্থী দেওয়া দলের রাজনৈতিক কৌশল ছিল। কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন সেই কৌশলের বাস্তবে প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়ে। আর এই দ্রুত মনোনয়ন পদ্ধতি মেনে কী ভাবে সম্ভব হল, তার স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছে না রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের তথ্য বলছে, রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত আসনের জন্য তৃণমূলের মনোনয়ন জমা পড়েছে মোট ৮৪ হাজার ১০৭। মোট আসন-সংখ্যার চেয়ে যা হাজারদশেক বেশি। স্ক্রুটিনি-পর্বে অবশ্য এক প্রতীকে এক আসনে এক জন প্রার্থীই থাকতে পারবেন। তখন হিসেব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এত কম সময়ে বিপুল সংখ্যক মনোনয়ন সম্ভব হল কী করে? দিনপ্রতি মনোনয়নের সময় বরাদ্দ ছিল চার ঘণ্টা করে। চতুর্থ দিনের শেষে কমিশনের হিসেবে তৃণমূলের প্রার্থী ছিল ৯ হাজারের কিছু বেশি। শেষ দু’দিনে জমা হয়েছে ৭৪ হাজারের বেশি মনোনয়ন। অর্থাৎ ওই শেষ দু’দিনের ৮ ঘণ্টার হিসেবে ধরলে ঘণ্টা পিছু ৯ হাজারের বেশি মনোনয়ন জমা পড়েছে ধরতে হয়। আরও ভেঙে বললে, এক-একটা মনোনয়নের জন্য সময়ের ভগ্নাংশের অঙ্ক কষতে হচ্ছে! কাগজপত্র পরীক্ষা করে, সই-সাবুদ সেরে বাস্তবে কি এই গতি সম্ভব? প্রশ্ন বিরোধীদের।
জেলার প্রশাসনিক কর্তারা জানাচ্ছেন, সব নথি এবং প্রস্তুতি ঠিক থাকলে, এক-একটি মনোনয়নে গড়ে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। কারণ, মনোনয়নে চার-পাঁচটি মূল নথি লাগে। সেগুলি যাচাই করতে হয় এবং নির্দিষ্ট বয়ান নথিবদ্ধ করতে হয়। কিন্তু পঞ্চায়েতের মতো নির্বাচনে বেশির ভাগ জায়গাতেই প্রার্থীদের আবেদনপত্র (ফর্ম) পূরণে সহযোগিতা করতে হচ্ছে আধিকারিকদেরই। কখনও কখনও আবার প্রার্থীদের কাছে সব নথি থাকছে না। ফলে, সে সবে সময় লাগছে আরও বেশি। প্রশাসনিক কর্তাদের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলালে বাস্তবে এত মনোনয়নে আরও অনেক বেশি সময় লাগার কথা। সরকারি ভাবে কিন্তু মনোনয়নের সময় বাড়ানো হয়নি। তবে বিকেল ৩টের আগে লাইনে দাঁড়ালে তাঁদের মনোনয়ন শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে কমিশন সূত্রের বক্তব্য।
‘রহস্যে’ আরও মাত্রা যোগ হয়েছে শুক্রবার কমিশনের দু’দফায় দেওয়া দু’রকমের হিসেবে। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কমিশনের তথ্য বলছে, তৃণমূলের মনোনয়ন জমা হয়েছে ৮৫ হাজার ৮১৭। কিন্তু বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত তথ্য নিয়ে দেওয়া পরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের মনোনয়ন রয়েছে ৮৪ হাজার ১০৭ আসনে। জেলা থেকে আসা তথ্য পর্যায়ক্রমে মূল তালিকায় যোগ হলে সংখ্যা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ যাত্রায় সংখ্যা কমে গিয়েছে!
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ এই বিষয়ে মুখ খোলেননি। কমিশন সূত্রের বক্তব্য, কত সময়ে কত মনোনয়ন জমা পড়ল এবং কী ভাবে পড়ল, তা বলা সম্ভব নয়। তবে মোট আসনের চেয়ে বেশি সংখ্যায় তৃণমূলের মনোনয়নের বিষয়ে কমিশনের বক্তব্য, এক আসনে কোনও দলের একাধিক ব্যক্তি মনোনয়ন দিতেই পারেন। পরে দেখতে হবে, সংশ্লিষ্ট দল কাকে মনোনয়ন (প্রতীক) দিচ্ছে।
শাসক দলের মনোনয়নের গতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ পাল্টা বলেছেন, ‘‘বিজেপি-সহ বিরোধীদের আর কিছু করার নেই বলে হাতে স্টপওয়াচ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে! বিজেপি এবং তার দোসরেরা জানে, ভোটের ফল তাদের পক্ষে যাবে না। তাই নানা ষড়যন্ত্রের গল্প তৈরি করছে। বাস্তব হল, বাংলার ইতিহাসে এটাই সব চেয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে।’’
বিরোধীদের প্রশ্ন অবশ্য থামছে না। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘এত মনোনয়ন তো গোপনে হতে পারে না! সিসিটিভি-তে ছবি নেই, লাইনে লোক নেই অথচ মনোনয়ন হয়ে গেল। ডিসিআর কেটে মনোনয়ন নিতে ন্যূনতম একটা সময় লাগে। আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, রাত পর্যন্ত বসে বসে প্রশাসনিক স্তরে হিসেব মেলানো হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনা থেকে মনোনয়ন শেযের পরে রাতে রিপোর্টই যায়নি। যথাযথ তদন্ত হলে চাকরির ওএমআর শিটের মতো বেআইনি কাজ ধরা পড়বে!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ, রাজ্য প্রশাসনের সহায়তায় ‘গোলমেলে’ কাজ করা হয়েছে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সুধাংশু ত্রিবেদীও মন্তব্য করেছেন, ‘‘রাজ্যে চার ঘন্টায় তৃণমূলের ৪০ হাজার প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। যার অর্থ প্রতিটি মনোনয়ন পিছু দু’মিনিট করে সময় লেগেছে। পঞ্চায়েত ভোটে যে ভাবে মনোনয়ন জমা হয়েছে, তা আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপহাস মাত্র!’’
তৃণমূলের নেতা তাপস রায় আবার পাল্টা বলছেন, ‘‘নিয়ম মেনেই মনোনয়ন জমা হয়েছে এবং সেটা হয়েছে অনেক জায়গায়। বিরোধীরাও তো অনেক মনোনয়ন দিয়েছেন। কাগজপত্রে অনিয়ম থাকলে স্রুটিনিতে বাতিল হবে। সব কিছু নিয়েই অভিযোগ তোলা ঠিক নয়!’’