পার্থের গ্রেফতারি নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে তৃণমূল। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
এসএসসি দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে ধৃত মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে আপাতত রয়েছে তাঁর দল। শনিবার সন্ধ্যায় তৃণমূলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে তা স্পষ্ট। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস আইন-আদালতের উপর পূর্ণ আস্থা রাখে। বিষয়টি এখন আদালতে গিয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি, বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হয়। দীর্ঘ, দীর্ঘদিন ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলে। আমরা চাই, খুব দ্রুত, এক বা দু’মাসে তদন্ত শেষ করে বিষয়টি আদালতকে জানিয়ে দিতে হবে।’’ পাশাপাশিই কুণাল বলেন, ‘‘বিচারে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস দলগত এবং সরকারি হিসেবে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে।’’
অর্থাৎ, পার্থ ইডির হাতে গ্রেফতার হলেও তিনি রাজ্যের মন্ত্রী থাকছেন। যেমন থাকছেন তৃণমূলের মহাসচিব পদেও। কিন্তু একইসঙ্গে তৃণমূল আইন-আদালতের উপর আস্থা রাখছে।
এসএসসি দুর্নীতির মামলায় শনিবার সকালে পার্থ ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরেই প্রশ্ন উঠেছিল, এর পর কি পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? তাঁকে কি সরিয়ে দেওয়া হবে দলের মহাসচিব পদ থেকে? নাকি মামলা চলা পর্যন্ত সাসপেন্ড করা হবে? নাকি হাওয়ালা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী যা করেছিলেন, তা-ই করবেন পার্থ নিজে? অর্থাৎ, মামলা চলাকালীন মন্ত্রিত্বে থাকবেন না।
কৌতূহল ছিল, পার্থের বিরুদ্ধে দল এবং সরকারের তরফে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়েও। কুণাল-সহ তৃণমূলের অন্য নেতাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে স্পষ্ট, আপাতত পার্থের পাশেই রয়েছে দল এবং সরকার। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত পার্থের পাশে রয়েছেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বস্তুত, সাংবাদিক বৈঠকের শেষদিকে কুণালকে সরাসরি আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন করেছিল, পার্থ চট্টোপাধ্যায় কি দলীয় পদে এবং মন্ত্রিসভায় থাকবেন? কুণাল জবাবে বলেন, ‘‘আপনার কি এত কথা শোনার পর মনে হল, সীতা কার বাবা!’’
শনিবার ওই সাংবাদিক বৈঠকের আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন দলের মুখপাত্র কুণাল এবং দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস। এঁরা তিনজনেই সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন। ছিলেন রাজ্যের অপর মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও।
কুণাল বলেন, ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে, তা কাল (শুক্রবার) প্রথম জানতে পারি ইডির সূত্র থেকে। যে টাকা উদ্ধার হয়েছে, যাদের বিষয়ে ইডির তরফে ওই কথা বলা হয়েছে, তাকে মান্যতা দিয়েই সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস জানাচ্ছে, ওই টাকার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। যাঁর (অর্পিতা মুখোপাধ্যায়) বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে, তিনি বা তাঁর আইনজীবীরা এর জবাব দিতে পারবেন।’’
এর পরেই কুণাল বলেন, ‘‘এঁর (অর্পিতা) সঙ্গে কোনও একটা সম্পর্কের কথা বলে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু কোন অনুষ্ঠানে কার সঙ্গে কার দেখা হয়েছে, সেটা কোনও বিষয় হতে পারে না।’’ তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, দল হিসেবে তৃণমূল পার্থের পাশেই দাঁড়াচ্ছে। প্রসঙ্গত, পার্থের পৃষ্ঠপোষিত নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোয় তাঁর সঙ্গে অর্পিতার ছবি নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কুণাল তথা তৃণমূলের বক্তব্য, সেই ছবির সূত্র ধরে কারও সঙ্গে কারও ‘সম্পর্ক’ বা ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা বলা যায় না। একই বক্তব্য মন্ত্রী অরূপেরও।
চন্দ্রিমা কিছু না বললেও কুণাল, ফিরহাদ এবং অরূপ পার্থের গ্রেফতারির পিছনে ‘রাজনৈতিক’ কারণও দেখিয়েছেন। ফিরহাদ যেমন বলেছেন, ‘‘দু’মাস আগে আদালত সিবিআইকে তদন্তভার দিয়েছে। তার মধ্যে পার্থদা ওয়াশিং মেশিনে ঢুকে গেলে কোনও তদন্ত হত না। আমি ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিনি। তাই আমাকেও জেলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু একই মামলায় (নারদ-কাণ্ড) অন্য একজনকে (শুভেন্দু অধিকারী) কোনও তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়নি। বিজেপি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে রাজনৈতিক কাজে লাগাচ্ছে।’’
তবে ফিরহাদও কুণালের সুরেই বলেছেন, ‘‘তৃণমূল কোনও অন্যায় করে না। কোনও অন্যায় সহ্যও করে না। দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেবে। কিন্তু কেউ ষড়যন্ত্রের শিকার হলে তার প্রতিবাদও করবে!’’
অরূপ বলেন, ‘‘২১ জুলাইয়ের সমাবেশের সাফল্যে বিজেপি ভয় পেয়েছে। কারও সঙ্গে কারও ছবি জুড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছএ না। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছে, তাদের সঙ্গেও তো বিজেপির অনেকের ছবি দেখা গিয়েছে!’’
প্রসঙ্গত, শনিবার বিকেল নাগাদ ইডি গ্রেফতার করেছে ইডির খাতায় ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ বলে বাদি-কার অর্পিতাকে। তাঁর ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হয়েছে ২১ কোটি টাকারও বেশি নগদ, ডলার, বিস্তর মোবাইল ফোন এবং অলঙ্কার। শুভেন্দু-সহ বিজেপির নেতারা দাবি তুলতে শুরু করেছেন, অর্পিতার সঙ্গে ‘নিবিড় যোগাযোগ’ রয়েছে তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্বের। সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূল জানিয়ে দিল, অর্পিতার সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই। উদ্ধার হওয়া টাকাও দলের নয়।
সাংবাদিক বৈঠকে বিরোধীদেরও কড়া আক্রমণ করেছেন কুণালরা। কুণালের কথায়, ‘‘বিরোধীদের এ বিষয়ে কথা বলার কোনও অধিকার নেই। ৯৯.৫ শতাংশ কাজ ভাল হচ্ছে। হয়তো .৫ শতাংশ কাজ খারাপ হচ্ছে। দল তা সংশোধন করে নেবে। মাথার উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন। অভিষেক রয়েছেন। কিন্তু একটা ঘটনা দিয়ে বাকি ভাল কাজগুলোকে ঢেকে দেওয়া যাবে না।’’
কুণালের আরও বার্তা, ‘‘তৃণমূল অটুট ছিল। অটুট থাকবে। আমাদের আইন এবং বিচার বিভাগের উপর পরিপূর্ণ আস্থাও থাকবে।’’