রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। —ফাইল চিত্র।
সন্দেশখালি-কাণ্ডে পাল্টা সুর চড়াতে শুরু করল শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। দলের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে ‘বঙ্গ-বিরোধী প্রচার’ হিসেবে উল্লেখ করে আইনি পদক্ষেপের দাবি তুলল তারা। পাল্টা প্রচারে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কেন্দ্রীয় রিপোর্টকেই হাতিয়ার করেছেন রাজ্যের শাসক নেতৃত্ব। পাশাপাশি, এই ঘটনায় ‘রাজনৈতিক প্রচারের পরিকল্পনা’ সংক্রান্ত একটি ‘অডিয়ো ক্লিপ’ প্রকাশ করে বিজেপির দিকেই আঙুল তুলেছে তারা।
দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের উপরে ‘হামলা ও নিগ্রহে’র অভিযোগ সামনে রেখে আক্রমণের ধার বাড়াচ্ছে বিজেপিও। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বুধবার বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের আমলে দলদাস পুলিশের ভূমিকা বাম আমলকেও ছাপিয়ে গিয়েছে! পুলিশের অত্যাচার সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়েছে। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের সব জেলায় পুলিশ সুপারের অফিস, কমিশনারেট এলাকায় ডিসি অফিসে অবস্থান চলবে।’’ অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে সুকান্ত অবশ্য বলে রেখেছিলেন, ‘‘আগামী কাল (বৃহস্পতিবার) প্রত্যেকটি এসপি অফিসের সামনে দুপুর দু’টো থেকে বিক্ষোভ হবে দুর্নীতির প্রশ্নে।’’ পরে সেই কর্মসূচিই সুকান্তের উপরে ‘পুলিশি হামলা’র প্রতিবাদে বদলে নিয়েছে বিজেপি। স্থানীয় পুলিশের তরফে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহলকে পাঠানো রিপোর্টে অবশ্য একটি ভিডিয়ো ক্লিপ দিয়ে বলা হয়েছে, বসিরহাট সাংগঠনিক জেলা বিজেপির সম্পাদক ও মহিলা মোর্চার নেত্রী সিরিয়া পরভিন বিবির হ্যাঁচকা টানেই পুলিশের গাড়ির বনেটে পড়ে যান সুকান্ত। দুই পুলিশ-কর্মীকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ আছে সিরিয়ার বিরুদ্ধে। তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
স্থানীয়দের ক্ষোভের মুখে প্রাথমিক ভাবে দলের এক নেতাকে সাসপেন্ড করলেও সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তৃণমূল পাল্টা আক্রমণেই নেমে পড়েছে। মন্ত্রী শশী পাঁজা ও রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ দলের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কুণালের দাবি, ‘‘জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা এলাকা ঘুরে বলেছেন, ধর্ষণ বা মহিলাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও অভিযোগ পাননি। তার পরেও বিজেপি ও সিপিএম পরিকল্পিত ভাবে বাংলা-বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে!’’ মন্ত্রী শশী বলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন? বিজেপি নেতারা ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।’’
এমতাবস্থায় বসে নেই সিপিএম ও কংগ্রেসও। কেন বারবার সন্দেশখালির নানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে বিরোধীদের আটকানো হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এ দিন বলেছেন, ‘‘তৃণমূল বলেছিল, খেলা হবে! খেলা বন্ধ করার জন্য মহিলারা রাস্তায় নেমেছেন। তৃণমূলের মহিলা কংগ্রেস এখন বলছে সমাবেশ করতে যাবে, কী করেছে এত দিন? চোরের মায়ের বড় গলা জানতাম, মহিলা কমিশন কী করেছে?’’ সিপিএম সূত্রের খবর, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবলীনা হেমব্রমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আজ, বৃহস্পতিবার সন্দেশখালি যাবে। বসিরহাটে দলের প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সর্দারকে আদালতে পেশ করা উপলক্ষেও মিছিল ও জমায়েতের ডাক দিয়েছে সিপিএম। সেখানে থাকার কথা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও সন্দেশখালি যাওয়ার কথা কাল, শুক্রবার। তার আগে অধীর এ দিনও বলেছেন, ‘‘কেউ কোথাও কোনও দিন ১৪৪ ধারা জারি করে কুকীর্তি চেপে রাখতে পারেনি, তৃণমূলও পারবে না! স্বামী ও বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে মহিলাদের নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে সন্দেশখালিতে। পুলিশ সব জানে। তৃণমূল নেতাদের বলব, আপনারা আয়নায় মুখ দেখতে পারেন? বাড়ির মা-বোনেদের কথা মনে পড়ে না?’’
তৃণমূল যে ‘চক্রান্তে’র অভিযোগ তুলছে, তার জবাবে রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ওখানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে কেউ মনোনয়ন দিতে পারেনি। যাঁরা মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তা হলে চক্রান্ত করল কারা? যে মহিলারা অভিযোগ করছেন, তাঁদের সিংহভাগ নিজেদের তৃণমূল বলে প্রকাশ্যে দাবি করছেন। আর কলকাতায় বসে বললে হবে বিজেপি চক্রান্ত করছে?’’ জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে কুণাল যে দাবি করেছেন, তার প্রেক্ষিতে শমীকের পাল্টা দাবি, ‘‘যাঁরা অভিযোগ করছেন, আদৌ তাঁদের সঙ্গে মহিলা কমিশনের সদস্যেরা কথা বলতে পেরেছেন কি না, সন্দেহ আছে। মহিলারা প্রকাশ্যে নিজেদের নির্যাতনের কথা বলছেন। এর পর কে কী বলল, কিছু যায় আসে না!’’
তৃণমূল এ দিনই একটি অডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ করে দাবি করেছে, সেখানে বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল এবং বিজেপির ‘আইটি সেল’-এর কো-অর্ডিনেটর নেতার কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। সেখানে সন্দেশখালির ঘটনার প্রচারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা ওই অডিয়ো ক্লিপ যাচাই করেনি। অগ্নিমিত্রার যদিও পাল্টা বক্তব্য, ‘‘যে কথোপকথনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা মোটেও গোপন নয়! সমাজমাধ্যমে প্রায় এক হাজার অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে কথোপকথন চলছিল। তৃণমূলের নেতারা রোজ রাতে গ্রামের মহিলাদের সম্মান লুট করতে তাঁদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যেতেন, এই বর্ণনা আমরা বাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। বাংলার মা-বোনেদের গিয়ে গিয়ে বলব তৃণমূল এক হাজার টাকার বিনিময় মহিলাদের সম্ভ্রম লুট করে। এটা কি অপরাধ?’’
কুণাল এ দিন বলেন, ‘‘সন্দেশখালিকে কেন্দ্র করে চরম কুৎসা চলছে। রাজনৈতিক নাটক করছেন কেউ কেউ। কেউ অন্যায় বা জুলুম করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। নিচ্ছেও। কিন্তু বঙ্গ-বিরোধী প্রচার চলছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘কেন্দ্রের বিভিন্ন রিপোর্টই বলছে, বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকারই জঙ্গল-রাজ চালাচ্ছে!’’