মুকুল রায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার তৃণমূল ভবনে। নিজস্ব চিত্র
রাজনীতির আঙিনায় তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে এখন তৃণমূল। কিন্তু বিধানসভার খাতায় তাঁর নাম এখনও বিজেপির ঘরে। বাইরে দলবদলের পরে বিধানসভায় এ বার মুকুল রায়কে ঘিরে কী ঘটবে, মুকুলিত হতে শুরু করল সেই চর্চা! বিধায়ক-পদ রেখে দিয়ে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) মাথায় তাঁকে দেখা যেতে পারে কি না, শুরু হয়েছে সেই জল্পনাও।
কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্র থেকে জীবনে প্রথম বার বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন মুকুলবাবু। এক মাস তিন দিন আগে বিধায়ক হিসেবে শপথ নিতে বিধানসভায় গিয়ে বিজেপির ঘরের দিকে পা-ই বাড়াননি! বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সে দিনই দলের নবনির্বাচিত বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন আর মুকুলবাবু বিধানসভার অন্য ফটক দিয়ে ঢুকে শপথ নিয়ে এবং তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বিজেপি নেতৃত্বের এখন যা মনোভাব, মুকুলবাবুর তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের পরে তাঁর বিধায়ক-পদ খারিজের জন্য বিধানসভায় আবেদন জমা পড়বে। প্রশ্ন হল, তার পরে কী হবে?
গত কয়েক বছরে কংগ্রেস ও বাম ছেড়ে শাসক দলে যোগ দেওয়া একগুচ্ছ বিধায়কের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সেই দৃষ্টান্ত মাথায় রাখলে স্পিকারের বিবেচনাধীন বলে মুকুলবাবুর বিষয়টিও অনির্দিষ্ট কাল ঝুলিয়ে থাকতে পারে। এমনকি, বিজেপির অস্বস্তি বাড়িয়ে পিএসি-র মাথায় তাঁকে বসানোর পথও অন্তত কাগজে-কলমে খোলা!
দু’দিন আগেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী চ্যালেঞ্জের সুরে বলেছিলেন, ‘‘দল ভাঙানোর খেলা তৃণমূলই প্রথম শুরু করেছিল। এখন তারা দল ভাঙিয়ে দেখাক। দলত্যাগ-বিরোধী আইন কী ভাবে কার্যকর করতে হয়, তা জানা আছে।’’ মুকুলবাবু বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার পরে শুক্রবার অবশ্য শুভেন্দুর বক্তব্য জানা যায়নি। এই প্রশ্নে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বাইরে কে কী মন্তব্য করেছেন, তার কোনও মান্যতা নেই। সে সবের ভিত্তিতে কিছু বলাও যায় না। আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও আবেদন এলে তখন নিয়ম মোতাবেক দেখা হবে সংশ্লিষ্ট সদস্যের পদ খারিজ হতে পারে কি না।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেওয়া দুই সাংসদ সুনীল মণ্ডল ও শিশির অধিকারীর সাংসদ-পদ এখও বহাল আছে। দলত্যাগ-বিরোধী আইনে তাঁদের সাংসদ-পদ খারিজের আবেদন জানিয়ে তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দু’বার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি দিয়েছেন। তা হলে মুকুলবাবুর ক্ষেত্রেই বা ‘তাড়াহুড়ো’র কী আছে? তা ছাড়া, বিগত বিধানসভায় কংগ্রেস ও বাম শিবির থেকে যে সব বিধায়কদের তৃণমূলে নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কারও বিরুদ্ধেই দলত্যাগ-বিরোধী আইন প্রয়োগ করা হয়নি। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘খেলা এত সহজ নয়! এক্তিয়ার সম্পূর্ণই স্পিকারের হাতে।’’ প্রাক্তন এক কংগ্রেস বিধায়কও মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাম জমানায় সোমেন মিত্র ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেস পরিষদীয় দলের আবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম দু’জনের বিধায়ক-পদ দ্রুত খারিজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার স্পিকার বিমানবাবুর আমলে তা হয়নি। নিয়ম-রীতি এ ক্ষেত্রে স্পিকারকেই ‘স্বাধীনতা’ দিয়েছে।
এই ‘স্বাধীনতা’র সূত্রেই জল্পনা হচ্ছে, স্পিকারের বিশেষ নির্দেশে মুকুলবাবু কি পিএসি-র চেয়ারম্যান হতে পারেন? পাঁচ বছর আগে মানস ভুঁইয়ার ক্ষেত্রেই সেই উদাহরণ আছে। বিজেপি সূত্রের অবশ্য খবর, মুকুলবাবুর মতি-গতি ঠিক নেই বুঝেই শেষ পর্যন্ত বিধায়ক অশোক লাহিড়ীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে পিএসি-র শীর্ষ পদের জন্য। যদিও প্রথম দিকে অশোকবাবু ওই পদে আগ্রহী ছিলেন না। বিরোধী দলের হাতে মোট কমিটির সংখ্যাও কমে আসতে পারে বলে সরকারি সূত্রে ইঙ্গিত। পাঁচটি হাউস কমিটি ও চারটি স্থায়ী কমিটি মিলে মোট ৯টি কমিটি দেওয়া হতে পারে বিজেপিকে।
তবে যাবতীয় ভাবনাই আবার অন্য মোড় নিতে পারে মুকুলবাবুকে তৃণমূল শেষ পর্যন্ত রাজ্যসভার জন্য বেছে নিলে। তখন আবার মুকুলবাবু বিধায়ক-পদ ছেড়ে দিলে ওই কেন্দ্রে কি তাঁর পুত্র শুভ্রাংশু রায়কে শাসক দলের প্রার্থী দেখা যেতে পারে? নানা জল্পনাই এখন মুকুলিত!