—প্রতীকী চিত্র।
থানার কাছেই লুকিয়ে রয়েছে ১৭ জন বাংলাদেশি। ভাড়ার ঘরে থেকে রীতিমতো ভুয়ো নথি তৈরির কাজ চলছে। তারা দিন গুনছে আসল ভারতীয় পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার। যা নিয়ে তারা বিদেশে পাড়ি দেবে। অথচ, কিছুই জানে না কলকাতা পুলিশ! একটি পাচার-মামলার সূত্র ধরে এই চক্রের মাথাকে ধরতে এসে শেষ পর্যন্ত আনন্দপুর থানা এলাকার গুলশন কলোনি থেকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ধরে নিয়ে যায় ওই ১৭ জনকে!
বছর তিনেক আগের সেই ঘটনায় মুখ পুড়েছিল কলকাতা পুলিশের। পরে একাধিক বার এই শহরেই জঙ্গিদের ঘাঁটি গাড়ার কথা সামনে আসায় লালবাজারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নকল নথি দিয়ে সহজেই ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করার চক্রের খবরে সম্প্রতি ফের উঠেছে প্রশ্ন। সীমান্ত পেরোনো বা নকল নথি দিয়ে পাসপোর্ট তৈরির মতো বিষয় জানতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন? অথচ, এ সব রোখার জন্যই তো নজরদারি চালানোর কথা। নিয়ম মেনে নথি ও ঠিকানা যাচাই হওয়ার কথা পাসপোর্ট তৈরির আগে। তবে কি এর কিছুই হয় না? নানা অভিযোগ সামনে এলেও প্রশাসন কি চোখ বুজেই থাকে? আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কে, কোথায়, কী ভাবে, নকল নথি তৈরি করছে, তা সব ক্ষেত্রে ধরা সম্ভব নয় বলে দাবি পুলিশের। কিন্তু সেই নথি ব্যবহারের সময়ে তো ধরতে হবে। সে ক্ষেত্রেও গাফিলতি হলে মুশকিল।’’ তাঁর মতে, ‘‘দিনের পর দিন বিনা বাধায় কার্যোদ্ধার হচ্ছে, তাই এই কাজ বন্ধ হচ্ছে না।’’
ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরির জন্য নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়। সে জন্য আধার এবং ভোটার কার্ডের নকল তৈরির পাশাপাশি স্থানীয় পুর প্রশাসন ভবন, স্কুল, কলেজ হাসপাতাল থেকেও নকল নথি তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধির ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ, বহু ক্ষেত্রে সহযোগীদের কাছে ঠিকানা ও আয় সংক্রান্ত প্রমাণপত্র অনেক সংখ্যায় সই করে রেখে দেন পুরপ্রতিনিধিরা। এলাকার লোক পরিচয়ে যে কেউ সেই কাগজ নিয়ে যেতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। এর পরে সহজেই পাসপোর্টের আবেদন করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী একাধিক স্তরে সেগুলি যাচাই হওয়ার কথা।
যদিও কলকাতার আঞ্চলিক পাসর্পোট অফিসের কর্তারা জানাচ্ছেন, তাঁদের নথি যাচাইয়ের তেমন বন্দোবস্তই নেই। দাখিল করা নথি একটির সঙ্গে অন্যটি মিলিয়ে দেখা ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না। এক কর্তার কথায়, ‘‘জন্মের শংসাপত্রে দেওয়া তারিখের সঙ্গে প্যান কার্ডের তারিখ না মিললে বা ব্যাঙ্কের পাসবইয়ের সঙ্গে অন্য প্রমাণপত্রের তথ্য না মিললে ধরতে পারি। কিন্তু সব ঠিক থাকলে নথিগুলি নকল না আসল, তা ধরার উপায় নেই। তাই পুলিশি যাচাইয়ে (পুলিশ ভেরিফিকেশন) জোর দেওয়া হয়।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, বর্তমানে থানায় এক জন করে পাসপোর্ট সংক্রান্ত অফিসার রয়েছেন। এর সঙ্গেই আছেন পুলিশের ‘সিকিয়োরিটি কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন’-এর তরফে পাসপোর্ট অফিসার। আবেদন জমার পরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অনুরোধে পুলিশ আবেদনকারীর ঠিকানায় গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখে, নথি যাচাই করে রিপোর্ট দেয়। কোনও আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা, তা-ও তখনই দেখার কথা। কিন্তু এই কাজে যুক্তদের দাবি, ঠিকানায় যাওয়ার বদলে দাখিল করা নথি নিয়ে পুলিশ কোনও একটি জায়গায় আবেদনকারীকে আসতে বলে। সেখানে নথি দেখে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পাশাপাশি, পুলিশি যাচাইয়ে ছাড় পেতে টাকার খেলা চলে বলেও অভিযোগ। সম্প্রতি জেলা পুলিশের এক কর্তার পাশাপাশি কয়েক জন পুলিশকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। জানা যায়, নকল নথির ভিত্তিতে আসল পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার চক্রের সঙ্গে যুক্ত তারা। ভুয়ো নথি দিয়ে আবেদনকারীদের নাম আগেই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের জানিয়ে দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে তারাই নিজে থেকে ওই সব আবেদনের তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্ব নিয়ে সব ‘ঠিক’ আছে বলে রিপোর্ট দেয়। তার ভিত্তিতেই তৈরি হয় পাসপোর্ট।
কিন্তু ওই চক্র ধরা পড়ার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি কেন? লালবাজারের যুক্তি, যে সমস্ত নথি দিয়ে আবেদন করা হয়, তা যথাযথ ভাবে দেখে রিপোর্ট দিতে অন্তত ৩০ দিন সময় লাগার কথা। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট দেওয়ার তাড়ায় যথেষ্ট সময়ই দেওয়া হয় না। যদিও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্তাদের দাবি, ২১ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিলে বাড়তি পারিশ্রমিক পান সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মী। কিন্তু ২১ দিনের পরেও সব খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেওয়া যায়। ওই কর্তা বলেন, ‘‘প্রমাণপত্র যথাযথ ভাবে যাচাই না করেই রিপোর্ট দেওয়ার
জন্য পুলিশকে তাড়া দেওয়ার এক্তিয়ার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নেই।’’
কলকাতার নগরপাল মনোজ বর্মা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। গাফিলতির প্রমাণ উঠে এলে, যাঁর বিরুদ্ধেই আসুক, কড়া পদক্ষেপ করা হবে।" তাঁর আরও দাবি, নতুন করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঠিকানা খুঁটিয়ে মিলিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। যদিও আগেই কেন এই পদক্ষেপ করা হয়নি, সেই প্রশ্ন রয়েছে। পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নথি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এই দায় ঠেলাঠেলিই বা বন্ধ হবে কবে? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি।
(চলবে)