Cyclone Amphan

আবার ফিরল সেই টাকা ফেরানোর দৃশ্য, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে কি? ধন্দ তৃণমূলেই

আগুনে ঘি ঢেলেছে ক্ষতিপূরণের টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ভূরি ভূরি অভিযোগ। কখনও উত্তাল হয়েছে দেগঙ্গা, কখনও মাকড়দহ।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২০ ২৩:৪২
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঠিক এক বছর আগের দৃশ্য যেন ফিরল রাজ্যের রাজনৈতিক চিত্রপটে। কাটমানি যদি কেউ নিয়ে থাকেন, ফেরত দিন— ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে দলকে বার্তা দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারুদের স্তূপে যেন স্ফূলিঙ্গ পড়েছিল। গ্রামে গ্রামে কাটমানি ফেরত চেয়ে তৃণমূলের পঞ্চায়েত ও পুর প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলেছিল এই জুন-জুলাইতেই। টাকা ফেরাতেও শুরু করেছিলেন অনেকেই। এ বছরও সেই জুন-জুলাই। এ বছরও সেই টাকা ফেরানোর মিছিল। আদৌ কি উজ্জ্বল হচ্ছে ভাবমূর্তি? একমত নয় দল। তৃণমূলের সামনের সারির নেতারাও দ্বিধাবিভক্ত।

Advertisement

দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে দানা বেঁধেছে বিক্ষোভ। একে লকডাউনের জেরে বিপর্যস্ত ছিল অর্থনৈতিক অবস্থা। তার মধ্যেই আমপানের (প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন) প্রবল ঝাপটা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের অবস্থা দক্ষিণবঙ্গের অন্তত গোটা পাঁচেক জেলায়। আগুনে ঘি ঢেলেছে ক্ষতিপূরণের টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ভূরি ভূরি অভিযোগ। কখনও উত্তাল হয়েছে দেগঙ্গা, কখনও মাকড়দহ। কোথাও পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষকে ঘেরাও করে রেখে ভাঙচুর চালিয়েছে উত্তেজিত জনতা। কোথাও বিজেপি কর্মীরা তৃণমূলের নেতাকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন। কোথাও পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে বিক্ষোভ থামাতে। কোথাও আবার পুলিশও উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। শুক্রবারও পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থেকে ধুন্ধুমার বিক্ষোভের খবর এসেছে। সেখানে আবার তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়েই বিক্ষোভ হয়েছে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে ঘিরে।

পরিস্থিতি যে এই দিকে গড়িয়ে যেতে পারে, তা সম্ভবত আগেই আঁচ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সর্বদল বৈঠক ডেকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোনও দুর্নীতি বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু নীচের তলায় তত দিনে যা হওয়ার, অনেকটাই হয়ে গিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ে ঘর ভাঙার ‘হিসেব’ জমা পড়ে গিয়েছিল প্রশাসনের ঘরে। কারা ক্ষতিপূরণ পাবেন, কারা পাবেন না, তার তালিকাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই সব তালিকা প্রকাশ্যে আসা শুরু হতেই অশান্তির আগুন আরও তীব্র হতে শুরু করল জেলায় জেলায়। অতএব দলগত ভাবে পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে তৃণমূল। স্বজনপোষণ বা ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে যে সব পঞ্চায়েত বা পুর প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে, তাঁদের শোকজ করছে তৃণমূল। কারওকে সাসপেন্ডও করা হচ্ছে। অন্যায্য ভাবে নেওয়া ক্ষতিপূরণ ফেরত দিতেও বাধ্য করা হচ্ছে অনেককেই।

Advertisement

সাগরদ্বীপে তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।—ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: করোনায় আক্রান্ত লকেট, নিজেই জানালেন টুইট করে​

টাকা ফেরতের এই প্রক্রিয়া শুরু হতেই কিন্তু বিরোধী শিবির নতুন অস্ত্র শানাতে শুরু করেছে। ক্ষতিপূরণের টাকা অন্যায্য ভাবে শাসক নেতারা যে নিয়েছেন, তা কি আর কোনও ভাবে গোপন থাকল? প্রশ্ন তুলছে, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দল। ‘‘টাকা যে তাঁদের প্রাপ্য নয়, অন্যায্য ভাবে যে টাকা পেয়েছেন, সে কথা তো ফর্ম ফিলআপ করে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। এর পরেও পুলিশ-প্রশাসন চুপ করে বসে থাকছে কী ভাবে! এঁদের বিরুদ্ধে তো আগে এফআইআর হওয়া উচিত,’’— বলছেন বিধানসভার বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী।

তৃণমূল অবশ্য সে যুক্তি নস্যাৎ করছেন। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তথা আমপান বিধ্বস্ত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘‘কোনটা বেশি জরুরি? এফআইআর করা? নাকি টাকাটা ফেরানো?’’ খাদ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘ভারতে আর একটাও রাজনৈতিক দলকে দেখাতে পারবেন না, যে দল স্বচ্ছতার লক্ষ্যে এই রকম পদক্ষেপ করতে পারে। ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোনও দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না, মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন। তার পরেও যাঁরা এ সব করেছেন, টাকা ফেরত দিতে তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে। এত বড় পদক্ষেপ করার সাহস, আর কোন দলের রয়েছে দেখিয়ে দিন।’’

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এই ব্যাখ্যাকে অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছে সব বিরোধী দল। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘টাকা ফেরানোটা কি কোনও রাস্তা হতে পারে? সরকারি টাকা যে প্রকাশ্যে লুঠ হল, সেটা তো বিরাট বড় অপরাধ। আগে এই সব নেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন পদক্ষেপ করুক। অবিলম্বে এঁদের গ্রেফতার করা হোক।’’ সায়ন্তনের কথায়, ‘‘ক’জন টাকা ফেরত দিচ্ছেন? ক’জনের দুর্নীতি ধরা পড়ছে? কেন্দ্রীয় সরকার ১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল। তার ৯৫ শতাংশ লুঠ হয়ে গিয়েছে। ৫ শতাংশ টাকাও কি ফিরবে? সবই তো লোকদেখানো। দুর্নীতি রোখার সদিচ্ছা যদি সত্যিই থাকত, তা হলে তো আগে এঁদের গ্রেফতার করানো হত।’’

গ্রেফতার যে কাউকে করা হবে না, এ রকমটা আগে থেকে ধরে নিচ্ছেন কেন বিরোধীরা? পাল্টা প্রশ্ন তৃণমূলের। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, ‘‘দল নির্দেশ দিয়েছে, কেউ যদি অন্যায় ভাবে টাকা নিয়ে থাকেন, আগে ফেরত দিতে হবে। সেটা আগে হোক। সময় হলেই প্রশাসনিক ব্যবস্থাও হবে। কেউ ছাড় পাবে না।’’ ছাড় যে মিলবে না, সে বার্তা কিন্তু খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সনও ফের শুনিয়ে দিয়েছেন শুক্রবার। বিধায়ক এবং জেলা সভাপতিদের নিয়ে এ দিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছিলেন তিনি। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিপূরণ নিয়ে যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, তাঁদের কাউকে ছাড়া হবে না, কেউ যেন তাঁদের বাঁচানোর চেষ্টা না করেন— শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রকমই কঠোর বার্তা দিয়েছেন বলে খবর। পঞ্চায়েত প্রধান হন বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, দুর্নীতির প্রমাণ পেলে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবেই, মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলের বৈঠকে এ দিন এমনই জানিয়ে দিয়েছেন বলে খবর।

মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তাকেও যথেষ্ট বলে মনে করতে রাজি নন সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, ‘‘ক্ষতিপূরণের টাকা যাঁরা অন্যান্য ভাবে নিয়েছেন, সেই তৃণমূল নেতারা এখন কান ধরে উঠবোস করছেন, টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করছেন, ফর্ম ফিলআপ করছেন, সে সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, ফর্ম ফিলআপ করিয়ে টাকাটা সরকার ফেরত নিচ্ছে কী ভাবে? কার কাছে ফেরত যাচ্ছে টাকা? কার কাছে জমা থাকছে? সে টাকা পরে কী হবে? কিছুই তো জানা নেই। এ তো আরও বড় অস্বচ্ছতা!’’ তা হলে কী করা উচিত ছিল? সুজনের জবাব, ‘‘আগে এই লুঠেরাদের গ্রেফতার করা দরকার ছিল। আর তার পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে কোনও একটা স্কিম বা পরিকল্পনা ঘোষণা করা জরুরি ছিল। সেই স্কিমের দায়িত্বে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকবেন, সেই স্কিমের আওতায় টাকা ফেরত হবে, সেই স্কিমের মাধ্যমেই ফের ন্যায্য প্রাপকদের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে। হওয়া তো উচিত ছিল এই রকম।’’

এ তো গেল টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়া বা দুর্নীতি দমনের পদ্ধতি নিয়ে চাপান-উতোর। কিন্তু বিতর্কের শেষ তো সেখানেই নয়। বাইরে থেকে আসা এই আক্রমণের মাঝে ঘরেও রয়েছে মতবিরোধ। আমপান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যা চলছে জেলায় জেলায়, তার মোকাবিলা কি আদৌ ভাল ভাবে করতে পারছে দল? তৃণমূলের অন্দরে এ নিয়ে এখন নানা মত। অনেক এলাকাতেই টাকা ফেরত দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা, তা ঠিক। কিন্তু টাকা যে লুঠ হয়েছিল, সেটাই কি আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না এতে? এমন প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। যদিও নেতৃত্বের সামনে নয়।

নন্দীগ্রামের হাজরাকাটায় পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ স্থানীয়দের। —ফাইল চিত্র।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হন বা পূর্ব মেদিনীপুরের কোনও গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, অনেকেই এখন টাকা ফেরত দিয়ে বলছেন, অজান্তেই টাকা ঢুকেছিল অ্যাকাউন্টে। কোনও পঞ্চায়েত প্রধানের দাবি, তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম কে যে জমা দিয়েছিল বিডিও অফিসে, তাঁর জানা নেই। কোথাও আবার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বলছেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের নামে টাকা ঢুকে গিয়েছে ভুল করে, তাঁর নয়, প্রশাসনের ভুল। অর্থাৎ ক্ষোভের মুখে পড়ে হোক বা নেতৃত্বের চাপে পড়ে, টাকা অনেকেই ফেরত দিচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশই দুর্নীতির অভিযোগ কবুল করছেন না। আর দুর্নীতির অভিযোগ যদি কেউ কবুল না করেন, সকলেই যদি ‘ভুল করে টাকা ঢুকেছে’ তত্ত্ব খাড়া করে পার পেয়ে যান, তা হলে পুলিশ কি কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে? মুখ্যমন্ত্রী তো বলেছেন, দুর্নীতি প্রমাণ হলেই ব্যবস্থা। দুর্নীতি কি কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ হবে? বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন এই নিয়েই।

সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েতের নেতারা ভুয়ো তালিকা পাঠিয়েছেন, বিডিও সেই তালিকা অনুমোদন করে দিয়েছেন, জেলাশাসকের দফতর থেকে চেক ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তলা থেকে উপর পর্যন্ত সবাই তো এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে। নেতাও জড়িয়ে, প্রশাসনিক কর্তাও জড়িয়ে। কোন প্রশাসনিক কর্তা কার বিরুদ্ধে তদন্ত করবেন, আর কে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?’’

তৃণমূলের অন্দরেও তর্ক ঠিক এই বিষয় নিয়েই। কাটমানি-কাণ্ডে যেমন দলের ভাবমূর্তি প্রবল ধাক্কার মুখে পড়েছিল, এ বার ক্ষতিপূরণের টাকা ফেরাতে গিয়েও সেই একই কাণ্ড হল বলে অনেকে মনে করছেন। ফর্ম ছাপিয়ে টাকা ফেরত নেওয়া হচ্ছে, সুতরাং টাকা যে লুঠ হয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সব নেতাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা যাবে কি না, ঠিক নেই। করা গেলেও তার সংখ্যা নগণ্য হবে বলেই রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ধারণা। সে ক্ষেত্রে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আদৌ কমবে তো? নাকি বেড়ে যাবে? এই প্রশ্নকে ঘিরে সংশয় অনেকের মধ্যেই।

রাজ্যের বনমন্ত্রী তথা তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। তবে ক্ষতিপূরণের টাকা লুঠের অভিযোগ ওঠা যে দলের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে, সে কথা অকপটেই মানছেন। রাজীবের কথায়, ‘‘দলের জন্য এগুলো ক্ষতিকর তো বটেই। দুর্গত মানুষের ক্ষতিপূরণের টাকা যাঁরা লুঠ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই দলের ক্ষতি করেছেন। এই ধরনের কিছু লোকের জন্যই বার বার দলের বদনাম হয়।’’ ফর্ম ছাপিয়ে টাকা ফেরতের যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে কি দলের সেই বদনাম কিছুটা কমবে? কৌশলী জবাব দিচ্ছেন রাজীব। বলছেন, ‘‘দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এগুলো তিনি বরদাস্ত করবেন না। যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। আমিও মনে করি, এঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হওয়া উচিত।’’ এটুকু বলেই সওয়াল-জবাব পর্ব শেষ করে দিচ্ছেন বনমন্ত্রী। এই সব নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হবে কি না, পদক্ষেপ না হওয়া পর্যন্ত বদনাম ঘোচার সম্ভাবনা কতটুকু, সে সব নিয়ে মুখ খুলতে তিনি রাজি নন।

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন। সময় মতো সব পদক্ষেপই হবে বলে তিনি দাবি করছেন। তবে দুর্নীতি বা লুঠ যে হয়েছে, তা জ্যোতিপ্রিয়ও অস্বীকার করছেন না। ‘ভুল করে টাকা ঢুকেছে’ বা ‘পঞ্চায়েতের নেতারা জানতেনই না, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম ক্ষতিপূরণ প্রাপকের তালিকায় কে ঢুকিয়ে দিলেন’— এই জাতীয় তত্ত্ব কিন্তু জ্যোতিপ্রিয়র মুখে শোনা যাচ্ছে না। সাধারণত বিরোধীদের যাবতীয় অভিযোগকে নস্যাৎ করে দেওয়াই যাঁর পরিচিত রাজনৈতিক ব্র্যান্ড, সেই জ্যোতিপ্রিয় এ বার একটু অন্য সুরে গাইছেন। দুর্নীতি যে হয়েছে, তা মানছেন। তবে দুর্নীতি রুখতে তৃণমূল যে সব পদক্ষেপ করেছে, তা করার সাহস অন্য কোনও দলের নেই বলে তিনি দাবি করছেন। আপাতত এ ভাবেই মুখরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

দুর্নীতি যতটা হয়েছে বলে বিরোধীরা দাবি করছেন, ততটা কিন্তু নয়— এই রকম একটা তত্ত্বও উঠে আসছে তৃণমূলের অন্দর থেকে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এক ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘মধ্যমগ্রাম বা বারাসত তো কলকাতা লাগোয়া। খুঁজে দেখুন না এই এলাকায়। ক্ষতিপূরণ নিয়ে কতটুকু ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে, একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করুন।’’ কথা মিথ্যা নয়। মধ্যমগ্রাম বা বারাসতে ক্ষোভের তীব্র আঁচ সে ভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না এখনও। টাউন যুব তৃণমূলের সভাপতি সুকুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘মধ্যমগ্রামে তো দুর্নীতি হওয়ার প্রশ্নই নেই। এখানে কাউন্সিলররা তালিকা বানিয়ে জমা দিয়েছেন। তার পরে ইঞ্জিনিয়াররা নিজেরা সার্ভে করে বুঝে নিয়েছেন, কার ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য, কার নয়।’’ সুকুমারের স্ত্রী সোমা মণ্ডল মধ্যমগ্রামেরই ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সুকুমার নিজে সেই ওয়ার্ড কমিটির সচিবও। তাই ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকা সুকুমারের হাত দিয়েই গিয়েছে। কী হাল সে তালিকার? মধ্যমগ্রাম পুরসভা সূত্রের খবর, ১২৭ জনের নামের তালিকা জমা পড়েছিল ২৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। সার্ভের পরে ১৩ জনের নাম বাদ পড়েছে। ১১৪ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অর্থাৎ কাউন্সিলরের দেওয়া তালিকা হুবহু পাশ হয়ে গিয়েছে এমন নয়। আবার অধিকাংশ আবেদনই খারিজ হয়ে গিয়েছে, এমনও নয়।

কিন্তু জেলা বিজেপির এক নেতা বলছেন, ‘‘মধ্যমগ্রাম-বারাসত দেখে কী হবে? এখানে তো ঝড়ের ঝাপটা সে ভাবে লাগেইনি। যে সব জায়গা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় পেরিয়ে গিয়েছে, সে দিকে যান। গ্রামের দিকে খোঁজখবর নিন। বুঝতে পারবেন ক্ষোভ আছে কি না।’’ গ্রামের দিকে পরিস্থিতি কিন্তু সত্যিই অন্য রকম। হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাসনাবাদ, বসিরহাট, স্বরূপনগর— সব এলাকা থেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভের খবর আসছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। বিভিন্ন বিডিও অফিস এবং পঞ্চায়েত অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ চলতে দেখা যাচ্ছে এই সব এলাকায়। বিজেপির বিক্ষোভের মুখে দাঁড়িয়ে স্বরূপনগরের বিডিও আশ্বাস দিয়েছিলেন, যাঁদের ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র পঞ্চায়েত জমা নিচ্ছে না, তাঁরা বিডিও অফিসে আবেদন জমা দিন। সেই অনুযায়ীই কাজ শুরু করেছিল বিজেপি। কিন্তু বিজেপির হাত ঘুরে জমা পড়া আবেদনগুলোর কী অবস্থা? স্বরূপনগর (মেন) মণ্ডল বিজেপির সভাপতি দেবাশিস বিশ্বাস বলছেন, ‘‘আমরা দুটো পঞ্চায়েতের প্রায় ১ হাজার ২০০ জনের আবেদন জমা করেছিলাম। আজ (শুক্রবার) ক্ষতিপূরণ প্রাপকদের নামের তালিকা বেরিয়েছে। ওই ১ হাজার ২০০ জনের মধ্যে ১ জনের নামও সেই তালিকায় নেই বলে খবর পেয়েছি।’’

বিজেপি নেতাদের ‘দুর্নীতির’ এই তালিকা তুলে ধরেছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

আরও পড়ুন: ইতিহাস সাক্ষী, মুছে যায় বিস্তারবাদীরা: লাদাখে দাঁড়িয়ে চিনকে বার্তা মোদীর​

পরিস্থিতি এই রকম হলে ক্ষোভ বাড়া অস্বাভাবিক নয়। মুখ্যমন্ত্রী যে নির্দেশই দিন, নীচের তলায় তা পালিত না হলে, ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করা মুশকিল। তবে বিজেপির অভিযোগের কথা শুনে পাল্টা আক্রমণে নামছেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয়। তিনি বলছেন, ‘‘বিজেপির কাছ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ শুনব? ওরা নিজেরা কী করেছে?’’ কী করেছে বিজেপি? ক্ষতিপূরণ দুর্নীতির সমান্তরাল তালিকা তুলে ধরছেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী। গাইঘাটা বিধানসভার ধরমপুর-২ পঞ্চায়েত, বাগদা বিধানসভার কানিয়ারা-২ পঞ্চায়েত এবং অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার বিজেপি নেতারা কী ভাবে ‘দুর্নীতি’ করেছেন, তার হিসেব চট করে সামনে নিয়ে আসছেন তিনি। পদক্ষেপ সবার বিরুদ্ধেই হবে— শুনিয়ে রাখছেন এই হুঁশিয়ারিও।

পদক্ষেপ হোক বা না হোক, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই গোটা প্রক্রিয়ার দায় কিন্তু কোনও ভাবেই নিচ্ছে না তৃণমূলের পরামর্শদাতা ‘আইপ্যাক’। ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা গত এক বছর ধরে প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে ফেলাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে দিয়ে। ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় ক্ষতিপূরণের টাকা লুঠের অভিযোগ ওঠার পরে সেই আইপ্যাক কি নিষ্ক্রিয়? পরিস্থিতি কেমন, তা সামলানোর জন্য কী করা উচিত, এ সব নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বকে কোনও পরামর্শ পিকে দেননি? লুঠ হওয়া টাকা ফর্ম ফিলআপ করিয়ে ফেরানোর মতো বড় সিদ্ধান্ত পিকের পরামর্শ ছাড়াই নেওয়া হল? আইপ্যাকের তরফে যথারীতি কোনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এ বিষয়ে নেই। তবে, ‘টিম পিকে’র সদস্যরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক। এর নেপথ্যে আইপ্যাকের কোনও ভূমিকা নেই।

পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, সে বিষয়ে কি নিশ্চিত হতে পারছেন না পিকের দুঁদে সমীক্ষকরাও? সেই কারণেই কি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে রাখার চেষ্টা? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তৃণমূলের আনাচেকানাচে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement