সাগরদিঘির হারে নতুন তত্ত্ব। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সাগরদিঘিতে কেন হার হল তৃণমূলের? পৌনে দু’বছর আগে যে আসনে বড় জয় মিলেছিল, সেখানেই এত খারাপ ফল কেন? এ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে যখন নানা প্রশ্ন, তখন অন্য দাবি করলেন স্থানীয় সাংসদ। সাগরদিঘি জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্র। সেই জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমানের দাবি, অন্তর্ঘাতই সাগরদিঘিতে হারের কারণ। কারা দলের সঙ্গে অন্তর্ঘাত করেছেন, তার খোঁজও চলছে বলে দাবি করেছেন তিনি। একই সঙ্গে অবশ্য দাবি করেছেন, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে মুসলিমরা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সব ক্ষেত্রে তো আর অন্তর্ঘাত হবে না!’’
সাগরদিঘি আসনের উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে প্রশ্ন উঠেছে, সংখ্যালঘু ভোট কি তৃণমূলের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে খলিলুর টেলিফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘এ বার সাগরদিঘির ভোটের পর থেকে সবাই যেটা ভাবছে, তেমনটা নয়। কিছুটা অন্তর্ঘাত আমাদের সঙ্গে হয়েছে।’’ কারা অন্তর্ঘাতের সঙ্গে জড়িত? এই প্রশ্নের উত্তরে খলিলুর বলেন, ‘‘কারা এই অন্তর্ঘাত করেছে, সে বিষয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি।’’ বিধায়করা এলাকায় পৌঁছলেই বৈঠক হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গত সপ্তাহে আমরা এই সংক্রান্ত বিষয়ে বৈঠক করেছিলাম। কিন্তু সে দিন সব বিধায়করা উপস্থিত থাকতে পারেননি বিধানসভার অধিবেশন থাকার কারণে। তাই আবার বৈঠক ডাকা হয়েছে।’’ শনিবার সেই বৈঠক হওয়ার কথা বলে জানিয়েছেন খলিলুর।
সাগরদিঘির ফল ঘোষণার দিনেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের ‘অনৈতিক’ জোটকে হারের কারণ হিসাবে দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘সাগরদিঘি উপনির্বাচনে আমরা হেরেছি। কাউকে দোষ দেব না। গণতন্ত্রে হার-জিত লেগেই থাকে। কিন্তু এখানে অনৈতিক একটি জোট হয়েছে। যার তীব্র নিন্দা করছি আমরা।’’ ৬৪ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের সাগরদিঘিতে কংগ্রেসের ঝুলিতে ৪৭.৩৫ শতাংশ ভোট চলে গিয়েছে সাগরদিঘিতে। কিন্তু এখন খলিলুর যা বলছেন, তাতে তৃণমূলের অন্দরের অন্য আলোচনা প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। খলিলুরের দাবি নিয়ে তৃণমূল অবশ্য পাল্টা কিছু বলতে চায়নি। দলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘দল পুরোদস্তুর বিশ্লেষণ চালাচ্ছে।’’
সাগদিঘিতে হারের পর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে বিপুল টাকা উদ্ধারের ঘটনাকে একটি ‘কারণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন কুণাল। এ ছাড়াও, সংখ্যালঘু বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকিকে দীর্ঘ দিন জেলে আটক রাখা, আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনাও একাধিক আলোচনায় উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, আনিসের বাবাকে নিয়ে গিয়ে সাগরদিঘিতে প্রচার করিয়েছিল বাম-কংগ্রেস জোট। তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই নিয়েও দলের অন্দরে বিক্ষিপ্ত বক্তব্য শোনা গিয়েছে। তবে সাংসদের মতো জনপ্রতিনিধির তরফে ‘অন্তর্ঘাত’-এর তত্ত্ব এই প্রথম!
সাগরদিঘিতে তৃণমূলের ভোট ৫০.৯৫ থেকে নেমে এসেছে ৩৪.৯৩ শতাংশে। এর পরেই সাগরদিঘিতে হারের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি গোটা বাংলার সংখ্যালঘু মনের খোঁজে কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন মমতা। ওই কমিটিতে রয়েছেন চার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমিন, আখরুজ্জামান এবং গোলাম রব্বানি। রয়েছেন জঙ্গিপুরের বিধায়ক জাভেদ খান। তবে সাংসদ খলিলুরকে রাখা হয়নি কমিটিতে। খলিলুর কমিটিতে জায়গা পাওয়া নিয়ে নিজে কিছু না বললেও তাঁর ঘনিষ্ঠ মুর্শিদাবাদের এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘যাঁদের নিয়ে কমিটি হয়েছে, তাঁরা কারণ খুঁজতে পারবেন কি? জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীকে পছন্দ করেন না এ রাজ্যের মুসলিমদের বড় অংশ। সাবিনা ইয়াসমিন এবং আখরুজ্জামানের মাটির সঙ্গে যোগ নেই। রব্বানি আর জাভেদকে অনেকেই তো বিহারি মুসলিম মনে করেন। ফলে এই কমিটি কতটা সত্য জানতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’’
২০১৯ সালে প্রথম বার জঙ্গিপুর লোকসভা দখল করেছিল তৃণমূল। ২,৪৫,৭৮২ ভোটে জেতেন খলিলুর। সাতটি বিধানসভা এলাকাতেই তৃণমূল ভাল ব্যবধানে জিতেছিল। সাগরদিঘিতেই ব্যবধান ছিল ৩৩,৪০৭ ভোট। পরে বিধানসভা নির্বাচনে অকালপ্রয়াত সুব্রত সাহা জেতেন ৫০,২০৬ ভোটে। সেই সাগরদিঘিতে অপ্রত্যাশিত হারের পরে কারণ সন্ধানে তৈরি কমিটিতে তিনি কেন নেই, তা নিয়ে অবশ্য আক্ষেপ নেই খলিলুরের। তিনি শুধু বলেন, ‘‘দল ঠিক করেছে কারা কমিটিতে থাকবেন। তবে সংখ্যালঘু ভোট দলের সঙ্গে ছিল, আছে এবং থাকবে।’’