নিজের বাড়িতে শুক্রবার সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদবকে স্বাগত জানাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।
সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বেরোনোর পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেস একাই লড়বে। এ বার দলের রণনীতি সংক্রান্ত বৈঠকে কংগ্রেসকে তুলোধোনা করে সেই অবস্থান ফের স্পষ্ট করে দিলেন তিনি। এমনকি, রাহুল গান্ধীকে বিজেপিই যে নিজেদের স্বার্থে বিরোধী শিবিরের মুখ হিসেবে দেখাতে চাইছে, সরাসরি সেই আক্রমণও করেছে তৃণমূল। একই দিনে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবও জানিয়ে দিলেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে নিয়ে তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে চান।
কালীঘাটে শুক্রবার দলের সাংসদ, বিধায়ক ও সাংগঠনিক পদাধিকারীরদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেই বৈঠকের পরে তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিরোধী পরিসরে কংগ্রেসের নেতা-সুলভ মনোভাব তাঁরা মানবেন না। বিজেপি ও কংগ্রেসের থেকে ‘সমদূরত্ব’ শব্দটি ব্যবহার না করলেও তৃণমূল বুঝিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সমন্বয় রেখেই এখন এগোনো হবে। সুদীপবাবু জানান, আগামী ২৩ মার্চ ওড়িশা যাওয়ার কথা মমতার। তখন ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে কথা হতে পারে তাঁর। পরে দিল্লি সফরেও যেতে পারেন মমতা। কংগ্রেসকে বাদ রেখে আঞ্চলিক শক্তির জোট গড়ে বিজেপির মোকাবিলার ক্ষেত্রে একই অবস্থান অখিলেশের দলেরও।
তৃণমূল এবং সমাজবাদী পার্টির এই অবস্থানকে অবশ্য কটাক্ষ করেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, প্রয়োজন হলেই তৃণমূল নেত্রী আবার সনিয়া গান্ধীর কাছে যাবেন। এখন বিরোধীরা নিজেদের মধ্যে নেতা বাছতে মারপিট করছে! সমাজবাদী পার্টি উত্তরপ্রদেশে হেরে এখন ‘রাজনৈতিক পর্যটনে’ বেরিয়েছে বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর পাল্টা অভিযোগ, মোদী-আদানি যোগের বিরুদ্ধে ১৮টি বিরোধী দল যখন একসঙ্গে সরব, তখন তৃণমূলের অবস্থান বিজেপিকেই সাহায্য করছে। কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়ার অভিযানে বিজেপির সহায়ক হচ্ছে তৃণমূল, এমনই অভিযোগ তাঁর। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীরও মত, রাহুল এবং কংগ্রেসকে নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি আছে বলেই তৃণমূলও তাদের নিয়ে আপত্তি তুলছে। তাতে আখেরে লাভ হচ্ছে বিজেপির।
রাজ্য স্তরে কংগ্রেস অনেক দিন ধরেই তৃণমূলের বিরোধী। সম্প্রতি সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বামেদের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস জয়ী হওয়ার পরে তাদের সঙ্গে সব স্তরেই তৃণমূলের সম্পর্ক বদলে গিয়েছে। সূত্রের খবর, আগামী লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে কালীঘাটে এ দিনের বৈঠকে মমতা বলেছেন, এ রাজ্যে কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নানা চেষ্টা করছে। তাদের দোসর হচ্ছে সিপিএম। আবার কেন্দ্রীয় স্তরে কংগ্রেস বিরোধীদের উপরে ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করছে। এই মনোভাব তাঁরা মানবেন না। মমতার মতে, তৃণমূল একলা চলার ক্ষমতা রাখে। রাজ্যে রাজ্যে যেখানে যে আঞ্চলিক দল ক্ষমতাশালী, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হবে। রাজ্যে বিজেপি টাকা দিয়ে ও আরও অন্য ভাবে আইএসএফ-কে সাহায্য করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেত্রী।
এই বৈঠকের পরেই কালীঘাটে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কিরণময় নন্দ, শিবলা যাদব, সুদীপ সেন প্রমুখ। দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক উপলক্ষে তাঁরা কলকাতায় এসেছেন। লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোটের কথা তাঁরা ভাবছেন না জানিয়ে অখিলেশ এ দিন অভিযোগ করেছেন, ইডি-সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে বিজেপি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিজেপির টিকা নিয়ে নিলে আর সিবিআই, ইডি বা আয়করের ভয় থাকে না!’’ লোকসভা নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক শক্তির সমন্বয় ও তৎপরতা কী ভাবে বাড়ানো যায়, সেই প্রসঙ্গে মমতা ও অখিলেশের আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। অখিলেশের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি দেশকে ধ্বংস করছে। তাদের আগে হটাতে হবে। বিজেপিকে হারাতে আমরা দিদির সঙ্গে আছি, উত্তরপ্রদেশে সর্বাধিক আসন জেতার লক্ষ্যে ঝাঁপাব।’’ নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে রাহুলকে বাদ দিয়ে তাঁদের কি অন্য কোনও মুখকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা আছে? অখিলেশের মতে, ‘‘এটা বলার বা ভাবার সময় এখনও আসেনি। পরে আমরা একসঙ্গে বসে এই নিয়ে আলোচনা করব।’’
তৃণমূলের বৈঠকের পরে সুদীপবাবু বলেছেন, ‘‘এ রাজ্যে কংগ্রেস এবং বিজেপি হাত মিলিয়ে চলছে। কেন্দ্রেও বিজেপি চাইছে রাহুল গান্ধীই বিরোধী শিবিরের মুখ হোন। কারণ, তাতে নরেন্দ্র মোদীর জিততে সুবিধা হবে! কিন্তু তৃণমূলও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল। তৃণমূল এটা প্রমাণ করবে, কী ভাবে বিরোধীদের একত্র করতে হয়!’’ কংগ্রেস যে আঞ্চলিক দলগুলিকে ‘প্রাপ্য মর্যাদা’ দিচ্ছে না, সেই অভিযোগ করে সুদীপবাবুর মন্তব্য, ‘‘কংগ্রেস যেন একেবারেই না ভাবে যে, ওরাই বিরোধীদের বিগ বস!’’ তাঁরা কি তা হলে তৃতীয় ফ্রন্ট চাইছেন? সুদীপবাবু ও রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানান, তাঁরা এখনই তৃতীয় ফ্রন্টের কথা বলছেন না। তবে আঞ্চলিক বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা চলছে।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্তের কটাক্ষ, ‘‘এই অবস্থানের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। ক’দিন বাদে দেখবেন, সনিয়া গান্ধীর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছেন! আমাদের এক নম্বর জায়গা পাকা। ওরা ‘ওয়েটিং লিস্টে’ আছে। নিজেদের মধ্যে নেতা বাছার জন্য মারপিট করুক।’’
লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরবাবুর বক্তব্য, ‘‘সাগরদিঘিতে হেরে যাওয়ার পরে তৃণমূলের যতটুকু মুখোশ ছিল, তা-ও খসে পড়েছে! ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র পরে রাহুল গান্ধী আরও বেশি করে মানুষের কাছে বিজেপি-বিরোধী মুখ হয়ে উঠেছেন। গোটা বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে আক্রমণ করতে ব্যস্ত। তাঁকে সংসদ থেকেও বার করে দেওয়ার চক্রান্ত করতে ছাড়ছে না বিজেপি। এই অবস্থায় তৃণমূলের বক্তব্য ও অবস্থান বিজেপিকেই খুশি করবে। মমতার সঙ্গে মোদীর ‘ম-মো’ চুক্তি হয়েছে!’’ অধীরবাবুর দাবি, ‘‘ভবিষ্যতে ফের পরিস্থিতি এলে বিজেপির সরকারে তৃণমূলকে যোগ দিতে দেখলেও আমি অন্তত অবাক হব না।’’
সিপিএমের নেতা সুজনবাবুর মন্তব্য, ‘‘সবাই জানে, বিজেপির মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টেরা। আর রাহুল গান্ধীকে এখন মোদী ভয় পাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে তৃণমূলের আপত্তির কারণ বিজেপির অস্বস্তি আছে বলেই। তৃণমূল তো বিরোধীদের মুখ নয়, মুখোশ! আগেই ধরা পড়ে গিয়েছে।’’