কেষ্ট কি না থেকেই রইলেন ভোটের বীরভূমে! গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
জেলা সভাপতি জেলে। বাংলাতেও নেই অনুব্রত মণ্ডল। দিল্লির তিহাড় জেলে এখন কেষ্টর বাস। তবে তাঁর জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এতটুকু বিচলিত নন তৃণমূল নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, দাদা না থাকলেও দাদার ‘টিম’ তো ছিল। অন্য দিকে, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ভোটের আগে ‘কেষ্টহীন বীরভূম’-এ ‘বীরত্ব’ দেখানোর কথা বললেও শনিবারের ভোটগ্রহণের পরে তাঁরাও বলছেন, অনুব্রত না-থাকলেও জেলা সভাপতির শেখানো পদ্ধতিতেই ভোট হয়েছে। ভোটের পরদিন রবিবার, ফলের আশা না-রেখে লড়াইয়ের কথাই শোনাচ্ছে গেরুয়া শিবির।
তবে রাজনীতিতে সাধারণত মনের কথা প্রকাশ্যে বলেন না নেতানেত্রীরা। সেই নিরিখে বীরভূম নিয়ে বিজেপি ‘সতর্ক’ বলা যায়। শনিবার ভোটের পর রাজ্য দলের এক নেতার কথা শুনে মনে হয়েছে, তিনি বীরভূম নিয়ে ‘অখুশি’ নন। তবে ফলাফলের আগে তা প্রকাশ্যে বলতেও তিনি নারাজ।
শনিবার ভোটের দিন সে ভাবে রক্তপাত দেখা যায়নি বীরভূমে। তবে বিরোধী নির্বাচনী এজেন্টদের বসতে না-দেওয়া থেকে বুথ দখল, ছাপ্পা, ভোট লুট এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল। বুথে আতঙ্কের মধ্যে থাকা মহিলা ভোটকর্মীকে হাউহাউ করে কাঁদতেও দেখা গিয়েছে। বিজেপি বলছে, সবই হয়েছে অনুব্রত জমানার মতো। জেলা বিজেপির সভাপতি ধ্রুব সাহার কথায়, ‘‘জেলার সব জায়গায় গোলমাল হয়েছে। নিঃশব্দে বিরোধীদের আটকে দিয়ে প্রহসন হয়েছে। অনুব্রত মণ্ডল না-থাকলেও তাঁর বালি, কয়লা, গরু মাফিয়ার দল তো ছিল। তারাই কাজ করেছে।’’
অনুব্রতর বদলে এ বার বিজেপির আঙুল জেলা তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য কাজল শেখের দিকে। তিনি এ বার জেলা পরিষদের প্রার্থীও। অনুব্রতের শেখানো ‘খেলা হবে’ স্লোগান পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে শোনা গিয়েছে কাজলের গলায়। ভোটের কয়েক দিন আগে নানুরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা রাতের অন্ধকারে প্রচারের নামে আদিবাসী, অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষজনকে টাকা দিয়ে, মদ খাইয়ে ভুল বোঝাতে আসবেন, তাঁদের দেখে নেওয়া হবে! তখন খেলাও হবে!’’ তবে অনুব্রতের কায়দায় ‘চড়াম চড়াম’ বা ‘গুড় বাতাসা’-র মতো ‘খেলা হবে’-র ‘ব্যাখ্যা’ দেননি কাজল।
রবিবার আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথায় কাজলের মুখেও বিজেপির সুর। বললেন, ‘‘কেষ্টদা না-থাকলেও তাঁর সাজানো টিমই তো রয়েছে জেলায়। তাতে তো কোনও বদল হয়নি। ফলে বীরভূমে তৃণমূল ছিল, আছে, থাকবে।’’ অনুব্রতের সাজানো টিমের কথা বলেও অবশ্য পর ক্ষণেই কাজল বলেন, ‘‘এখন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এই জেলার দায়িত্বে রয়েছেন। আর কে থাকল, কে গেল তাতে কী আসে-যাবে?’’
পুরাণ কাহিনিতে সর্বকালের সেরা সেনাবাহিনী ছিল দ্বারকারাজ শ্রীকৃষ্ণের (বাংলায় যিনি কেষ্টও বটে)। অশ্ব, হস্তি, পদাতিক মিলিয়ে ১২ অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল তাঁর। নাম ছিল, নারায়ণী সেনা। অনেকে বলেন, বাংলার বর্তমান রাজনীতিতে সবচেয়ে ‘কৌশলী’ বাহিনী রয়েছে অনুব্রতের। সেটা মানছে তৃণমূল। বলছে বিজেপিও। মঙ্গলবারের ফলই বলে দেবে কৃষ্ণের মতো কেষ্টর ‘নারায়ণী সেনা’ও সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ কি না। তিনি নিজে সশরীরে হাজির না-থেকেও, একটা ভোট উতরে দেওয়ার মতো দক্ষ বাহিনী তৈরি করতে পেরেছেন কি না, তা বোঝা যাবে ওই দিন।
জেলার ভোট সামলানোর বিশেষ দায়িত্ব কাজলের উপরে থাকলেও, শনিবার বোলপুরে জেলা পার্টি অফিসে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন দলের কোর কমিটির আহ্বায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী। দিনভর জেলায় ঘুরেছেন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। অন্য দিকে, বিজেপিকে মূলত অভিযোগ জানাতেই দেখা গিয়েছে। রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘বীরভূমে অতীতেও ভোটগ্রহণের দিনে বিশেষ গোলমাল হয় না। আসলে সেখানে ‘কৌশল’ নির্ভর ভোট করে তৃণমূল। এ বারেও সেটাই হয়েছে। বিজেপি কর্মীদের থেকে শুরু করে ভোটারদের আগে থেকেই হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বার হতেই দেওয়া হয়নি অনেক জায়গায়। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখার কাজটাও হয়েছে নীরবে।’’
বীরভূমে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতি এখনও টাটকা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের নজিরে ২০১৮-য় সবার উপরে ছিল অনুব্রতের জেলা। ৪২টি জেলা পরিষদ আসনের একটিতেও বিরোধী প্রার্থী ছিল না। গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতেও লড়াই ছিল কম। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জেলার দু’টি আসনেই জেতে তৃণমূল। তবে সেই দুই কেন্দ্রের অন্তর্গত ১১টি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটিতে এগিয়ে যায় বিজেপি। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে ক্ষত সারিয়ে তোলেন অনুব্রত। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপি জেতে মাত্র একটি আসনে। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে অবশ্য কৌশল বদলেছে তৃণমূল। বিরোধী প্রার্থীদের দাঁড়াতে না-দেওয়ার যে অভিঘাত সাধারণ মানুষের মনে ২০১৮ সালে পড়েছিল, এ বার তা কোনও ভাবেই চাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। তাই মনোনয়নের এক দিন বীরভূমের লাভপুরে বিজেপি প্রার্থীদের তৃণমূল কর্মীরা আটকে দিলেও, পর দিনই ক্ষমা চেয়ে বার্তা দিয়েছেন দলের বিধায়ক।
এ সব মিলিয়ে, এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেমন ফল হবে? বিরোধীরা কি একটু হলেও সুবিধা করতে পারবে? কোনও ভবিষ্যদ্বাণীতে রাজি নয় বিজেপি। ধ্রুব বলেন, ‘‘ফল কী হবে জানি না। যেখানে মানুষ ভোট দিতে পেরেছে, যেখানে আমরা প্রতিরোধ করতে পেরেছি, সেখানে বিজেপি জিতবে। কিন্তু সে আর কতটুকু এলাকায়? ভোট মিটে যাওয়ার পরেও তো পুলিশ বিজেপি কর্মীদের গ্রামে টিকতে দিচ্ছে না।’’ তৃণমূল নেতা কাজলও জয়-পরাজয় নিয়ে আগাম কিছু বলতে নারাজ। তিহাড় জেলে বসে অনুব্রত কি জানতে পারবেন তাঁর অনুপস্থিতিতেও ফল ধরে রাখতে পেরেছে দল? কাজলের জবাব, ‘‘মাঝে তো আর একটা দিন। অপেক্ষা করুন না!’’