Child Marriage

নেতাদের কাছে গেলেই নাবালিকা বিয়েতে ছাড়পত্র!

রাজ্য সরকারের ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এবং স্কুলে স্কুলে নজরদারির দাবি করা সত্ত্বেও সন্দেশখালি জুড়ে এই ছবি কেন?

Advertisement

নবেন্দু ঘোষ 

সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪ ০৫:৪৯
Share:

—প্রতীকী ছবি।

তিন বছর আগে সদ্যোজাত মেয়েকে কোলে নিয়ে মাধ্যমিক দিয়েছিল সন্দেশখালির দ্বারীরজাঙ্গাল বনমালী বিদ্যাভবনের ছাত্রী সোমা (নাম পরিবর্তিত)। তখন তার বয়স ১৬। এখন সে ঘোর সংসারী।

Advertisement

বেড়মজুর ২ পঞ্চায়েত এলাকার ১৭ বছরের আর এক কিশোরীর ইতিমধ্যে দু’বার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তবে, নানা কারণে সংসার করা হয়নি। পড়াশোনাতেও ইতি পড়েছে। সে-ও ওই স্কুলেরই ছাত্রী ছিল। এখন সে বাপের বাড়িতেই থাকে।

নদীর এ-পারে বেড়মজুর, ও-পারে সন্দেশখালি দ্বীপ। এলাকার মানুষজনের একটা বড় অংশ তো বটেই, অন্য কাজের সূত্রে এই অঞ্চলে যাতায়াত রয়েছে, এমন অনেকেই বলছেন, নাবালিকা বিয়ের এই ধরনের উদাহরণ নদীর দু’পারে আরও মিলবে। এমনই এক জনের সঙ্গে আলাপ ৮ নম্বর কর্ণখালিতে। মাধ্যমিক পাশ করার পরে বিয়ে হয়ে যায়। তা-ও আবার তৃণমূলের এক নেতার ছেলের সঙ্গে। তার পরে বছর সাতেক দীর্ঘ অত্যাচার সয়ে তিনি বাবার বাড়িতে ফেরেন। দুই সন্তান তাঁর। কতই বা বয়স হবে? বাইশ-তেইশ বছর হয়তো।

Advertisement

ছোট কুলগাছিয়া নদীর দু’পারে তাই একই দৃশ্য।

রাজ্য সরকারের ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এবং স্কুলে স্কুলে নজরদারির দাবি করা সত্ত্বেও সন্দেশখালি জুড়ে এই ছবি কেন?

কান পাতলেই শোনা যায় অভিযোগ, নাবালিকা বিয়ের প্রবণতায় লাগাম টানা যায়নি, কারণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

এই বিষয়ে সব থেকে ভাল জানেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। দ্বারীরজাঙ্গাল বনমালী বিদ্যাভবনের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা সূর্যতপা চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘ওখানে রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতাদের দাপট এমন ছিল যে, তখন আমাদের পক্ষে নাবালিকা বিয়ে বন্ধে তৎপরতা দেখানো সম্ভবই হয়নি। সে সব খবর অনেক দেরিতে পেতাম।’’

গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, বিভিন্ন এলাকায় শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের দাপট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তাঁদের অনুমতি নিয়ে যদি কোনও অভিভাবক নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিতেন, তা বন্ধ করতে সাহস দেখাতেন না কোনও শিক্ষক বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা। ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ বা ‘চাইল্ড লাইন’-এর সদস্যদেরও কিছু করার থাকত না। পুলিশের কান পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় খবর যেত না, বা পুলিশও সবসময় শাসক দলের নেতাদের উপেক্ষা করে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে পারত না বলেই অভিযোগ। পুলিশের অবশ্য দাবি, খবর পেলে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করা হত।

ব্লকের একটি স্কুলের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিকাশচন্দ্র পাল জানান, গ্রামের অনেক দরিদ্র অসচেতন অভিভাবক মেয়েদের বিয়ে দিতে চান দ্রুত। অনেক অভিভাবক এত দিন শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের কাছে যেতেন সাহায্য চাইতে। নেতারাও বিয়ে দিতে সাহায্য করতেন। কারণ, অভিভাবকদের মন পেতে চাইতেন তাঁরা।

সন্দেশখালি ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি, তৃণমূলের মহেশ্বর সর্দারের অবশ্য দাবি, ‘‘শাসকদলকে কালিমালিপ্ত করতে এই সব বলা হচ্ছে। আমরা নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার পক্ষে।’’ বিডিও অরুণকুমার সামন্ত বলেন, ‘‘সবসময় নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করা নিয়ে আমরা তৎপর।’’ কিন্তু গত বছর পর্যন্ত এ তল্লাটে কত নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, সেই তথ্য বিডিও দিতে পারেননি।

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সন্দেশখালি ২ ব্লকের শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানান, এখানকার প্রতিটি স্কুলে ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ আছে খাতায়-কলমে। ব্লকে মিটিং হয় নিয়ম মেনে। ‘কন্যাশ্রী দিবস’ও ঘটা করে পালন করা হয়। কিন্তু ব্লকের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য শিক্ষকেরা চাপে থাকতেন। ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে বিশেষ কোনও তৎপরতা কখনও কন্যাশ্রী ক্লাব ও শিক্ষকদের মধ্যে দেখিনি। আমাদের কাছেও কোনও খবর আসত না।’’

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement