বাঁশের খুঁটি পুঁতে বাঁধের কাজ চলছে হিঙ্গলগঞ্জের গ্রামে। শালবল্লার মতো মজবুত হয় না এই কাজ। ছবি: নির্মল বসু
আমপানের আগের রাতে ভাঙাচোরা কুঁড়ে ঘর ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে যাননি হিঙ্গলগঞ্জের তপন দাস। পড়শিদের অনুরোধ ফিরিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আর কত বার ঘরদোর গিলবে নদী! এ বার না হয় আমাদেরই খাক।"
আমপান ফের ঘর কেড়েছে তাঁর। বৃদ্ধ তপন বলেন, ‘‘এত বছরে কেউ শক্তপোক্ত বাঁধটুকু দিতে পারল না! ভরা কোটাল আর ফি বছর ঝড়ের চোখ রাঙানি আর সহ্য হয় না!’’
আমপানের পরে তছনছ হয়ে গিয়েছে সুন্দরবনের বহু এলাকার মাটির বাঁধ। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ভরা কোটালে ধুয়ে গিয়েছে আরও অনেক এলাকার দুর্বল বাঁধ। টিয়ামারি গ্রামের বাসিন্দা স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘বার বার জলে ধুয়ে যাবে বাঁধ— এই তো দেখে আসছি এত বছর ধরে।”
কেন এমন অবস্থা সুন্দরবনের বাঁধের? এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, বড় বিপর্যয় আসার আগে বাঁধ সারাইয়ের কথা মনে পড়ে সেচ দফতরের। তপন বলেন, “সারা বছর বাঁধের দেখভাল হলে এমন অবস্থা হত না।’’
আর এই কাজ নিয়েও বিস্তর অভিযোগ। সেচ দফতরের প্রাক্তন কর্তারা জানিয়েছেন, মজবুত বাঁধ তৈরি করতে হলে দরকার শালবল্লা। বাঁধের দু’ধার শালবল্লা দিয়ে ঘিরে মাঝখানে মাটি ভরে বাঁধ শক্ত করতে হবে। কিন্তু তা হয় কোথায়? দ্বীপবাসীর অভিজ্ঞতা, শালবল্লার বদলে বাঁশের খুঁটি পুঁতে কাজ চালানো হয় অনেক জায়গায়। বাঁশ আর শালবল্লার শক্তিতে বিস্তর ফারাক। জলে বাঁশের খুঁটি নষ্ট হয় দ্রুত। এর পরে আছে মাটি ফেলা নিয়ে নানা ধরনের ‘কারচুপি’।
বাঁধ-নামা
• দুই ২৪ পরগনা মিলিয়ে বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার
• এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। বাকি ২৫ শতাংশ উত্তরে।
• সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে মোট ২০০ কিলোমিটার কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হয়েছে। এর ৮০ শতাংশ দক্ষিণে।২০ শতাংশ উত্তরে।
কী রকম? পাথরপ্রতিমার বাসিন্দা হরেন নস্কর বলেন, “কখনও বাঁধের এক ধারের মাটি কেটে অন্য দিকে ফেলা হয়। এই কাজ বেশির ভাগ শুরু হয় বর্ষা নামলে। সপ্তাহ কাটতে না কাটতে তা ফের সাফ হয়ে যায়।” আয়লা, বুলবুল, ফণী বা আমপানের দাপট তো আছেই, সারা বছরই ভরা কোটালের জলে বা সাধারণ ঝড়ঝাপটায় ভাঙে সুন্দরবনের নদীবাঁধ। ভাসে গ্রামের পর গ্রাম, চাষের জমি।
হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলির বাসিন্দা বৃদ্ধ গণপতি মণ্ডল বলেন, ‘‘বাঁধ শক্তপোক্ত করে কোনও দিনই কেউ তৈরি করবে না। বাঁধ ভাঙলেই তো ওদের লাভ!’’
কাদের লাভ? কী লাভ?
আর মুখ খুলতে চান না বৃদ্ধ। তবে গ্রামের অনেকে জানালেন, বাঁধ তৈরি এবং মেরামতির জন্য কোটি কোটি টাকার টেন্ডার হয়। প্রচুর টাকা খরচও হয়। কিন্তু খুব পরিকল্পনামাফিক পাকাপোক্ত কাজ হয় না বলেই সেই বাঁধ মজবুতও হয় না। এ ভাবেই চলে বছরের পর বছর।
যোগেশগঞ্জের বাসিন্দা পরাণ দাসের কথায়, ‘‘সুন্দরবনের নানা প্রান্তে গজিয়ে ওঠা বেআইনি মেছোভেড়ি এবং ইটভাটার জন্যও বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে।’’
কী ভাবে? পরাণ জানান, ভেড়িতে জল আনার জন্য বা ইটভাটায় পলি জমানোর জন্য নদী থেকে খাল কেটে জল ঢোকানো হয় গ্রামে। ওই খালের পাড় খুবই নিচু থাকে। ফলে নদীতে জলস্ফীতি ঘটলেই জল ঢুকে পড়ে গ্রামে। আর এই কাজ করেন এলাকার প্রভাবশালী ‘কারবারিরা’। অভিযোগ, এ নিয়ে টুঁ শব্দ করতে গেলে জানপ্রাণও খোয়াতে হতে পারে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন সবাই।
একই অভিযোগ সুন্দরবনের বাঁধের অন্যতম রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ ধ্বংস নিয়েও। বেআইনি ভাবে বিঘের পর বিঘে জমির গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানি করা হয়। তা নিয়ে বহু বার বহু অভিযোগ হয়েছে। তবে কাজ কিছুই হয়নি। প্রাক্তন সেচকর্তাদের বক্তব্য, সব মিলিয়ে সুন্দরবনের বাঁধ রক্ষার সমস্ত কাজেই রয়েছে গোড়ায় গলদ।
তবে সেচ দফতরের আধিকারিকদের দাবি, সারা বছর পরিকল্পনামাফিক বাঁধের কাজ চলে। ম্যানগ্রোভের দিকেও নজর রাখা হয় বলে দাবি বন দফতরের। এক কর্তার কথায়, ‘‘গাছ কাটার অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’ তবে এ সব যে নিতান্ত কথার কথা তা আড়ালে মানেন সেচ এবং বন দফতরের কর্তারাও।
বাঁধ নিয়ে নানা অভিযোগের কথা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ শাজাহান মোল্লা। তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবন এলাকায় নদীবাঁধ মেরামতিতে আগামী দিনে যাতে দুর্নীতি না হয়, সে দিকে আমরা নজর রাখছি। দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গেও এ নিয়ে একাধিক বার আলোচনা হয়েছে।’’ বৈঁধ মেরামতির জন্য যে জমির প্রয়োজন, তা পেতে সমস্যা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি শামিমা শেখ। কী ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে বাঁধের কাজ হচ্ছে, সে দিকে তাঁরা নজর রাখেন বলে জানিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ গোস্বামী।
তবে কি বাঁধের নানা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়? (চলবে)