সাড়ে ১৩ বছরের শাসনে আরজি কর পর্বেই ‘কঠিন’ সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। —গ্রাফিক আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর মামলায় দোষীর যে শাস্তি হয়েছে, তাতে স্তম্ভিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তাঁর কথায়, ‘আদালত এই ঘটনাটিকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা হিসেবে দেখতে পেল না? আমি ফাঁসির দাবি জানিয়েছিলাম! কী ভাবে রায় দেওয়া হল যে এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়?’’
ঘটনার অব্যবহিত পরেই অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নেমে মিছিল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। আরজি করের ঘটনা নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশাপাশি নজিরবিহীন নাগরিক আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। রাজ্য জুড়ে মিটিং-মিছিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। কার্যত তারই ‘পাল্টা’ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন মমতা।তাঁর সঙ্গে সেই মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন দলের মহিলা নেত্রী এবং মহিলা সাংসদ-বিধায়কেরা। যদিও তার পরে তেমন মিছিল আর বিশেষ চোখে পড়েনি। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছিল নাগরিক আন্দোলনের ঝাঁজ। যা অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছিল ‘অগ্নিকন্যা’কে।
মমতা বলেন, আন্দোলনের গর্ভেই তাঁর জন্ম। দলের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে অভিহিত করে থাকেন ‘অগ্নিকন্যা’ বলে। সেই মমতাকে তাঁর দীর্ঘ শাসনকালের মধ্যে প্রথম অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল আরজি কর-কাণ্ডের পরে। বেনজির এবং অভূতপূর্ব আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রশাসক মমতাকে। যে আন্দোলনের জেরে খানিকটা পিছুও হটতে হয়েছিল তাঁর সরকারকে।
তৃণমূলের প্রথম সারির প্রায় সমস্ত নেতাই স্বীকার করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে সেই প্রথম এমন তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছিল। আরজি করের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। প্রথমে রাজি না হলেও পরে আন্দোলনের জেরেই কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল-সহ পুলিশ ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে সরাতে হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, পুলিশ এবং স্বাস্থ্য— এই দু’টি দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন মমতা স্বয়ং।
আরজি কর-পর্বে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সঙ্গে যে নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ মিশেছিল, তাতে গোড়ার দিকে শাসকদলের অনেকেই ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখতে শুরু করেছিলেন। যে আন্দোলন মূলত ছিল ঝান্ডা এবং দলহীন। প্রধান বিরোধীদল বিজেপি শুরু করেও আন্দোলন ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, ‘দলহীন’ নাগরিক আন্দোলনের নতুন স্বাদ পেয়েছিল বাংলা। অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে দেখা গিয়েছিল মানুষই মিছিল খুঁঝে নিচ্ছেন। ঝান্ডা দূরে সরিয়ে রেখে কৌশলে নাগরিক আন্দোলনে মিশে থাকার চেষ্টা করেছিল সিপিএম-সহ বামেরা। ‘মেয়েদের রাত দখল’ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিছিল, সভা, মানববন্ধনে মহিলারা যে ভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন, তা-ও অতীতে কখনও দেখেনি বাংলা। ফলে প্রশাসক মমতার কাছে আরজি কর পর্ব ছিল আক্ষরিক অর্থেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল গত বছর ৯ অগস্ট সকালে। তার ঠিক চার দিন আগে ৫ অগস্ট লাগাতার নাগরিক আন্দোলনের জেরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ওপার বাংলার সেই ‘আঁচ’ এসে পড়েছিল এ পারের নাগরিক আন্দোলনেও। বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনে স্লোগান উঠেছিল, ‘দফা এক, দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’। আরজি কর-কাণ্ডের পরে বিজেপি এবং সিপিএমও বাংলাদেশের অনুকরণে স্লোগান তুলেছিল, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’। যদিও দলহীন নাগরিক আন্দোলনে তেমন কোনও স্লোগান শোনা যায়নি। তবে সরকার বিরোধী ‘স্বর’ ছিল। যা ছিল আসলে ১৩ বছরের ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।
নাগরিক আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন মহিলারা। ভোটের বাক্সে মমতা তথা তৃণমূলের অন্যতম ‘পুঁজি’ মহিলাদের সমর্থন। ২০০৯ সালের লোকসভা থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের লোকসভা— সব ভোটেই যে সমর্থন উত্তরোত্তর বেড়েছে। কিন্তু আরজি কর আন্দোলনে মহিলাদের রাস্তায় নেমে পড়া নিয়ে শুরুর দিকে তৃণমূলের অনেকেই শঙ্কিত হয়েছিলেন। যদিও সেই নাগরিক আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল শহর এবং মফস্সলেই। গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু জায়গায় গোড়ার দিকে কর্মসূচি হলেও তা ‘সার্বিক’ ছিল না। যেখানে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানেও ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি। তবে মহিলাদের ক্ষোভ, রাস্তায় নেমে আসা যে সরকারকে আলোড়িত করেছিল, তা স্পষ্ট। পাশাপাশিই, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, সেই আন্দোলনের পাশে সিনিয়র চিকিৎসকদের দাঁড়ানো, কর্মবিরতির ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া অচলাবস্থা সরকারকে বিড়ম্বিত করেছিল।
২০১১ সালে মমতা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূলের জন্য অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি এসেছে। সারদা কেলেঙ্কারিতে দলীয় নেতাদের নাম জড়ানোর পরে প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে রাজনৈতিক ভাবে তার মোকাবিলা শুরু করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। আবার ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ফাঁস হয়েছিল ‘নারদ স্টিং অপারেশন’। গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল একাধিক তৃণমূল নেতা নগদ টাকা ঘুষ নিচ্ছেন। সেই পর্বে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আগে জানলে ওদের টিকিট দিতাম না।’’ সারদা বা নারদ দু’টির কোনওটিই তৃণমূলকে রাজনৈতিক ভাবে ‘বিপর্যস্ত’ করতে পারেনি। কিন্তু আরজি করের ঘটনা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক— দু’দিক থেকেই মমতাকে ‘বিড়ম্বিত’ করেছিল। কারণ, এই আন্দোলনে কোনও তথাকথিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না। ছিল দলহীন নাগরিকদের স্বর। যা মোকাবিলা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না মমতার।
কিন্তু তিনি এই পর্বে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে সমন্বয়ের কাজে ব্যবহার করা, স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে সশরীরে পৌঁছে যাওয়ার মতো একাধিক পদক্ষেপ করেছিলেন প্রশাসক মমতা। শেষপর্যন্ত গত ২১ অক্টোবর নবান্নের এক বৈঠকে ঘটনার ‘রাশ’ হাতে নেন তিনি। সেই বৈঠকের পরে ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশন’ তুলে নেনে জুনিয়র ডাক্তারেরা। যদিও তাঁরা দাবি করেছিলেন, অনশন তোলার সঙ্গে নবান্নের বৈঠকের কোনও সম্পর্ক নেই। নির্যাতিতার বাবা-মায়ের অনুরোধেই তাঁরা অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করছেন। সেই দিনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল সরকারি হাসপাতালে প্রস্তাবিত কর্মবিরতিও।
তার পর থেকেই নাগরিক আন্দোলনের ‘ঝাঁজ’ ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে। কমতে কমতে এখন তা বিলীন। নাগরিক সমাজ আবার ফিরে গিয়েছে দৈনন্দিনতায়। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন শাসকদলের নেতা-কর্মীরাও। ‘উপরি’ হিসেবে আরজি কর-কান্ডের পরে হওযা ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে হইহই করে জিতেছে তৃণমূল। বস্তুত, উত্তরবঙ্গে একটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে বিরোধী বিজেপির থেকে। স্বভাবতই, আরও ‘আত্মবিশ্বাসী’ হয়েছেন মমতা। কারণ, আন্দোলন চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে।
ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় গত ৯ জানুয়ারি জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে মিছিল এবং রাতভর অবস্থান হলেও তাতে সেই ‘ধার’ দেখা যায়নি। এমন বিভিন্ন রাজনৈতিক ‘সূচক’ বলছে, পরীক্ষা কঠিন ছিল। প্রথমে পিছুও হটতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে উতরে গিয়েছেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক এবং প্রশাসক মমতা। তবে শেষবেলায় সঞ্জয়ের শাস্তি সম্ভবত তাঁকে আবার কিছুটা পশ্চাদপদই করল।