—প্রতীকী ছবি।
ভূপেন হাজরিকা কণ্ঠের জনপ্রিয় গানকেও কবেই ছাপিয়ে গিয়েছেন ওঁরা। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গাইতে গিয়েও এত বার শব্দটা বলেননি তিনি।
বাংলায় ভোটের আবহে এ বার বিশেষ ভাবে সরগরম এই মানুষ-তত্ত্ব। দেশে বা রাজ্যে চাকরির আকালে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তায় কাতর বাবা আকছার বিলাপ করেন, ছেলেটা মানুষ হল না। সন্তানের একটু বেচাল দেখেই কত মায়ের আবহমান আর্তি, ঠাকুর ওকে মানুষ কর! কচি গলায় বাঙালির ছেলেমেয়েও বরাবর কলকলিয়ে কবিতা বলে ‘মানুষ তো নয়, ভাইগুলো তার...!’ তবু মানুষ শব্দের এমন ঘন ঘন বিস্ফোরণ কার্যত অভূতপূর্ব।
জ্যোতি বসুর প্রত্যয়ী ‘মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে’ বা আত্মসমীক্ষামূলক ‘আমরা মানুষকে বোঝাতে পারিনি’ লব্জ শুনেই কৈশোর, যৌবন কেটেছে কত বাঙালির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষ স্লোগান যে আমবাঙালির মনে ধরেছে তাতেও সন্দেহ নেই! তবে মানুষ বলতে তখনও মানুষ বুঝত মানুষ শুধু, হেসে বলছেন প্রবীণ রাজনীতিক সুব্রত মুখোপাধ্যায়। “মানুষকে এরা কী ভাবে, কে জানে! এখন তো মনে হচ্ছে, যার হুঁশ নেই, তাকেই মানুষ ভাবছে ওরা।” আজকের মানুষপন্থী দলত্যাগী নেতাদের প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত।
খালি মানুষ আর মানুষ! রাজনীতির মাঠে কারও কারও হঠাৎ জটিল রোগে দম বন্ধ হয়ে আসছে। দলে থেকে আর কাজ করতে পারছেন না! তার পরই শোনা যাচ্ছে, মানুষের জন্য কাজ করার স্বার্থে অন্য দলে যোগদানের ঘোষণা। লালন গেয়েছেন, মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে / সে কি অন্য তত্ত্ব মানে? এই মানুষ সেই মানুষ নয়, স্পষ্ট বলছেন বাউল-ফকির বিষয়ক গবেষক শক্তিনাথ ঝা। তাঁর চোখে, “বাউলদের কাছে মানুষ রতনই সব। কিন্তু মানুষ জীব হিসেবে জন্মায়। তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। বাউলদের তত্ত্বে মানুষ সবার উপরে, কারণ মানুষ সব থেকে চেতনাবান।”
এ কালের সমাজবিজ্ঞানী থেকে পরিবেশবিজ্ঞানীরা অবশ্য পৃথিবীর দুর্গতির জন্য নানা ভাবে মানুষকেই দায়ী করছেন। শিক্ষাবিদ দেবী কর বলছিলেন, “আজকের অভিভাবকেরাও সন্তান গুড হিউম্যান বিয়িং হয়ে উঠুক চান। কিন্তু এর আসল মানে কাজেকম্মে সফল হওয়া।” তাঁর আফসোস, “৫০ বছরের শিক্ষকজীবনে ছাত্রী-তালিকায় আমলা, শিক্ষক কত কী থাকলেও কোনও রাজনীতিবিদ নেই। রাজনীতিবিদ শব্দের সঙ্গে শ্রদ্ধার সম্পর্কও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।”
অনেকটা কি সে-ভাবেই রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে মানুষ শব্দের মানেও বিকৃত হচ্ছে? প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিচ্ছে অনেকের মধ্যেই। ছবি রিলিজের সময়ে মানুষ মানে দর্শক বা বক্সঅফিস। জনপ্রিয় লেখকের কাছে মানুষ মানে পাঠককুল। নেতাদের কাছে মানুষ মানে ভোটার বা জনগণ, না কি তিনি নিজে? ‘‘কোন মানুষ, কোথাকার মানুষ কেন মানুষ না-বললে সবটাই অস্বচ্ছ থাকে। এটা আসলে মানুষকে বাষ্পীভুত করে দেওয়া”, বলছেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। তাঁর মতে, “মানুষের এই আইডিয়াটাই আসলে এখন মানুষহীন। বড়জোর একটা অব্যয়!”
মানুষ আসলে কী চায়, তা শিগগিরই মালুম হবে!