দত্তপুকুরের বিস্ফোরণস্থল। —ফাইল চিত্র।
একটি ড্রামের মধ্যেই কি লুকিয়ে ছিল ‘মরণ ভোমরা’? বিস্ফোরক মশলায় বোঝাই সেই ড্রামটি উল্টে যেতেই কি এত বড় বিস্ফোরণ?
দত্তপুকুর কাণ্ডের পরে চার দিন পার হয়ে গেল। বিস্ফোরণ কী ভাবে হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বারাসত জেলা পুলিশের তদন্তকারী কর্তারা দায় সারছেন ‘তদন্ত চলছে’ বলেই। তবে প্রত্যক্ষদর্শী এবং তদন্তকারী আধিকারিকদের একাংশের ইঙ্গিত, ড্রাম উল্টেই এত বড় ঘটনা। এখনও বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হল না কেন— একই সঙ্গে উঠেছে এই প্রশ্নও।
রবিবার সকালে দত্তপুকুর থানার মোচপোলে যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে, তার পিছনে ঠিক কী রয়েছে, এটাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন। পুলিশের একাংশের কথায়, কী থেকে এবং কী ভাবে বিস্ফোরণ, তা বোঝা না গেলে তদন্ত ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও কঠিন। পুলিশের তরফে নিদিষ্ট করে কিছু বলা না হলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ‘বিস্ফোরক ভর্তি ড্রাম পড়ে যাওয়ার’ দিকেই ইঙ্গিত করছে। এই সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে বিস্ফোরণে মৃত সামসুলের মা আসুরা বিবির দাবি। তিনি দাবি করেন, বিস্ফোরণের আগে তিনি কেরামত আলিকে মশলা ভর্তি ড্রাম খুলতে দেখেছিলেন। তা হলে কি সেটি খোলার সময় পড়ে যায় এবং তার ফলেই বিস্ফোরণ হয়?
স্থানীয়েরা আরও দাবি করছেন, বিস্ফোরণের দিন সকালে মোচপোল পশ্চিম পাড়ার সামসুলের বাড়িতে কোনও রকম আগুন জ্বলতে দেখেননি। একই দাবি ছিল দুর্ঘটনার পরে উদ্ধার করতে আসা গ্রামবাসী থেকে শুরু করে দমকল কর্মীদেরও। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়া উঠেছিল ঘটনার সময়। সঙ্গে উড়েছে পাথর, ইটের টুকরো আর মানুষের শরীরে নানা অংশ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অজস্র চকলেট বাজি, বারুদ ছড়িয়েছিল। বিপুল পরিমাণ কাগজ ও প্লাস্টিক ছাড়াও ঘরে থাকা কাপড় ও কাঠের জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আগুনের চিহ্ন কোথাও ছিল না। বিস্ফোরণের পর দিন ঘটনাস্থলে আসা রাজনৈতিক নেতারাও ঘুরে দেখে অবাক হন। এই পরিস্থিতিতে শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেন, সামসুলের ঘরে আরডিএক্সের মতো শক্তিশালী বিস্ফোরক মজুত ছিল। বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার সেই দাবি উড়িয়ে দেন।
বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে আগুনের চিহ্ন না-পাওয়ার ফলেই নানা সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। একই সঙ্গে তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে মোচপোল এলাকায়। এমনকি বিস্ফোরণের এত দিন পরেও ঘটনাস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে গুদামে রাখা বস্তা বস্তা বাজি, মশলাও কেন সরানো হচ্ছে— ক্ষোভ বাড়ছে তা নিয়েও।
বুধবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, গুদাম পাহারায় পুলিশ রয়েছে গোটা কয়েক। গুদামে সারি সারি বাজির বস্তা রাখা। কিন্তু চমক অন্য জায়গায়। বস্তাগুলির কোনওটির উপরে লেখা এফসিআই, কোনওটির উপরে পঞ্জাবের খাদ্য দফতরের নাম, কোনওটিতে আবার লেখা রয়েছে কর্নাটকের নাম। এখানে প্রশ্ন, তা হলে কি পুলিশের চোখে ধুলো দিতেই এমন কারসাজি? বারাসত জেলা পুলিশের এক কর্তা যদিও বলছেন, ‘‘তদন্ত চলছে। ফরেন্সিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কোনও বিষয়ে নিদিষ্ট করে বলা যাবে না। এখান থেকে তৈরি জিনিস কোথায়, কী ভাবে যেত, সেই তদন্তও চলছে।’’ কিন্তু সেই রিপোর্টই বা কবে আসবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এলাকাতেই থাকেন রহমত আলি। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ দু’টো কথা বলে। খোঁজ চলছে আর তদন্ত চলছে। এখানে যে পুলিশরা আসত, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এলাকায় এখনও অনেকেই আছেন, যাঁরা রাসায়নিক, বাজি, বারুদ-সহ অন্যান্য মশলা মজুত করেন। তাঁদের ধরে পুলিশ জানুক। কেরামত ও সামসুল মারা গিয়েছে। বাকিরা তো মরেনি।’’
অন্য দিকে, বাজি উদ্ধারও অব্যাহত। মোচপোল পশ্চিমপাড়ার বিভিন্ন গুদাম, কাঠোর, বেরুনানপুকুরিয়া, নারায়ণপুর, জালসুখা এলাকার বহু গুদাম থেকে এ দিনও বাজি মিলেছে। বুধবার ব্যারাকপুর কমিশনারেটের শিবদাসপুর থানায় এলাকার দেবক গ্রামের পশ্চিমপাড়া থেকেও বাজি তৈরির সরঞ্জাম-সহ বেশ কিছু জিনিস আটক করে পুলিশ। এই ঘটনায় শেখ আব্দুল আসমান নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়। দত্তপুকুরের মোচপোলে অনেকে বাজি সরিয়ে নিচ্ছেন বলেও খবর। পুলিশ কেন ওই এলাকায় তল্লাশি করছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে, পুলিশি নিরুত্তরে জট বাড়ছে।