বিস্ফোরণে আহত হয়েছিলেন আসুরা বিবি ও তাঁর নাতি। এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নন তাঁরা। —নিজস্ব চিত্র।
ইট, বালি, সুরকি এখনও ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে জায়গাটায়। তার উপরেই ফেলে রাখা হয়েছে লাল, হলুদ রঙের প্লাস্টিকের জরি। বাজি কারখানার আড়ালে এই জরি দিয়েই নাকি রাসায়নিক এবং বারুদ ভর্তি বোমা বাঁধা হত এখানে! দূর থেকে বাড়িটাকে দেখলে এখন মনে হয়, কোনও এক বিশাল চাপে ভিতর থেকে ফেটে সমস্তটাই যেন গুঁড়িয়ে গিয়েছে। আশপাশের বাড়িগুলিও একই অবস্থায় কোনও মতে দাঁড়িয়ে। ভেঙে পড়া জানলার কাচ মেরামত হয়নি কোনওটিতেই। নতুন করে নির্মাণ হয়নি ধসে যাওয়া বাড়ির ছাদও। কয়েকটি বাড়ি আবার বসে যেতে শুরু করেছে! তার মধ্যেই বিপদ মাথায় নিয়ে বসবাস করছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বাড়ি সারাতে না পেরে এখনও রাত কাটাচ্ছেন রাস্তাতেই!
কালীপুজোর আগে এই মুহূর্তে বাজি নিয়ে নানা মহলে যখন জোর আলোচনা চলছে, তখনই ঘুরে দেখতে যাওয়া হয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের সেই বাজি বিস্ফোরণস্থল। গ্রামের নাম মোচপোল। গত অগস্টে হঠাৎই খবরের শিরোনামে উঠে আসে আপাত শান্ত এই জায়গাটি। সেখানে একটি দোতলা বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ন’জনের মৃত্যু হয়। দেহগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গিয়ে পড়ে আশপাশের বাড়িতে। বিস্ফোরণ হওয়া বাড়িটির তো বটেই, আশপাশের আরও কয়েকটি বাড়ির ছাদও উড়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, কোন ধরনের বাজি তৈরি করতে গেলে এতটা তীব্র বিস্ফোরণ হতে পারে? সেখানে বাজি না বোমা তৈরি হচ্ছিল, সেই প্রশ্নও তোলেন অনেকে। দেখা গেল, আশপাশের বহু এলাকায় চলা বাজির কারবার যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনই বদলায়নি ওই বাড়ি উড়ে যাওয়ার ফলে আশপাশের বাড়ির রাতারাতি ছাদ হারানো মানুষগুলির জীবন।
ধ্বংসাবশেষ: বাজি বিষ্ফোরণের পরে এখনও এ ভাবেই পড়ে রয়েছে জায়গাটি। দত্তপুকুর নীলগঞ্জের মোচপোল এলাকায়। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
তাঁদেরই এক জন, বছর পঞ্চাশের আসুরা বিবি বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়ির উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিলেন। কেমন আছেন আপনারা? প্রশ্ন শুনেও উত্তর দেন না তিনি। এর পরে কোনও মতে তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করা সম্ভব হয়। কোথা থেকে, কী জন্য আসা হয়েছে, বুঝে নিয়ে মহিলা দেখাতে শুরু করেন, মাথায়, মুখে, শরীরের নানা অংশে আঘাতের চিহ্ন। বলেন, ‘‘বিস্ফোরণে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে। কিছুই শুনতে পাই না।’’ এর পরে ঘরের ভিতরে ছুটে গিয়ে নিয়ে আসেন একরত্তি কোলের শিশুকে। দেখাতে শুরু করেন, সেই শিশুটির পায়ের পাতা, হাঁটু, কোমরের নানা কাটা দাগ। মহিলা বলেন, ‘‘অনেকেই এসে জানতে চান, কেমন আছি আমরা। এখন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। আমার এই নাতিও একটা পাঁচিলের নীচে চাপা পড়ে ছিল। কোনও মতে প্রাণে বেঁচেছে। গায়ের কাটা দাগগুলো শুকিয়েছে, কিন্তু ওর ভয় এখনও কাটেনি। সামান্য আওয়াজ শুনলেই কেঁপে উঠে কাঁদতে শুরু করে।’’
কথা শেষ করতে দিলেন না আসুরার পুত্রবধূ জসমিনা খাতুন। ভাঙা ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন, সেখানে ভেঙে পড়া ছাদের পাশেই এখন রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশপাশে পড়ে রয়েছে ভাঙা পাখা, সুইচ বোর্ড, আলমারি। খাটের উপরে এমন ভাবে পাঁচিল ভেঙে পড়েছে যে, সেখানে শোয়া তো দূর, বসারও অবস্থা নেই! জসমিনা বললেন, ‘‘ধীরে ধীরে বাড়িটা বসে যাচ্ছে। ছাদ তোলার বা সরানোর টাকা নেই। বেআইনি বাজি তৈরি করল অন্য লোক, কিন্তু ভুগছি আমরাও।’’
ভোগান্তির এই চিহ্ন বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়ির পাশের আর একটি বাড়িতেও। সেখানকার বাসিন্দা আজমিরা বিবি আবার দেখালেন, তাঁদের রাস্তার সংসার। বিস্ফোরণের পর থেকে তাঁরা রাস্তাতেই রয়েছেন। সেখানেই একপাশে ত্রিপল খাটিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে, অন্য পাশে রয়েছে কোনও মতে শোয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও এই অবস্থা কেন? ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যেরা বললেন, ‘‘বিস্ফোরণে আমাদের ছাদও ভেঙে পড়েছিল। এখনও সেই ঘর মাথা তুলে দাঁড় করাতে পারিনি। অভিযুক্তেরা সব পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কার কাছে ক্ষতিপূরণ চাইব?’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা এবং বজবজে ঘুরেও দেখা গেল একই চিত্র। চলতি বছরেই বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছিল মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ায়। তাতে এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী-সহ তিন জনের মৃত্যু হয়। বজবজের নন্দরামপুর দাসপাড়াতেও মারা যান তিন জন। দাসপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, মৃত যমুনা দাসের বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে আগের মতোই ঝলসে যাওয়া অবস্থায়। তবে, তার নীচে রাস্তাতেই বাজির দোকান পেতে বসেছেন অনেকে। পুটখালি মণ্ডলপাড়াতেও দেদার চলছে বাজির কারবার। বাড়ির পাশের যে কারখানায় মেয়ের মৃত্যু হয়েছিল, সেটি এখনও তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকলেও তার আশপাশের ঘরে দেদার বিক্রি চলছে বেআইনি বাজির। সেই সব দেখিয়ে মৃত ছাত্রী আলো দাসের মা বললেন, ‘‘যার যায়, তার যায়। বাকি জগৎ বাজি ফাটানোর ক্ষণিকের আনন্দেই মেতে থাকে।’’