নাস্তিক সম্মেলন। রবিবার নবদ্বীপে। — নিজস্ব চিত্র।
ইতিহাসবিদেরা বলেন, তাঁর হাত ধরেই বাংলায় এক নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। চৈতন্যদেবের প্রভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সেই চৈতন্যধাম নবদ্বীপে রবিবার হয়ে গেল রাজ্যের প্রথম নাস্তিক সম্মেলন। নাস্তিক মঞ্চের উদ্যোগে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, অসম, ত্রিপুরা, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা এসেছিলেন।
‘আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবিকে অস্বীকার করি’—বিরাট ফ্লেক্স নিয়ে পদযাত্রা দেখে কিছুটা চমকে উঠেছিলেন নবদ্বীপের মানুষ। ইতিহাসের নবদ্বীপে যে পথ ধরে একদা হেঁটেছেন বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর, কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তক রাজা বল্লাল সেন, তুর্কি হানাদার বখতিয়ার খিলজি। কালীর রূপকল্পের সন্ধানে ফিরেছেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। নব্যন্যায়ের চর্চা করেছেন রঘুনাথ শিরোমণি, বুনো রামনাথ। সেই পথেই এ দিন পদযাত্রা করলেন নাস্তিক মঞ্চের সদস্য-সদস্যারা। নাস্তিকতার স্বপক্ষে রাখলেন জোরালো বক্তব্য।
উদ্যোক্তাদের তরফে প্রতাপ দাস বলেন, “ধর্মযন্ত্রণা মুক্ত নাস্তিকতা ক্রমশ জনপ্রিয় বিশ্বদর্শন হয়ে উঠছে। বহু মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে জীবনের প্রতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন। ভারতেও বাড়ছে এঁদের সংখ্যা। ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১৮ শতাংশ ভারতীয় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। যা সংখ্যার হিসাবে প্রায় ২০ কোটি। ধর্মীয় মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান দাপটে সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতো।” মঞ্চের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতাপ বলেন, “এক, বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতির পথে নাস্তিকতার প্রচার ও প্রসার। দুই, নতুন ভাবে কুসংস্কার বিরোধী আইন প্রণয়ন এবং তার কঠোর প্রয়োগের দাবিতে জনমত তৈরি। তিন, বাকস্বাধীনতা বিরোধী ভারতীয় সংবিধানের ২৯৫ (এ) ধারা বাতিলের দাবি। চার, জাত ব্যবস্থার বিলোপ দাবি। বলতে পারেন এই মঞ্চ প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদীদের নিয়ে।”
২০২৩ সালে গড়ে ওঠা নাস্তিক মঞ্চের সদস্য সংখ্যা খাতায় কলমে এখনও পর্যন্ত ৬০ জন। নাস্তিকতার ব্যাখ্যায় কনিষ্ক চৌধুরী বলেন, “ভারতের নাস্তিক ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। ধর্মের উৎস বহুমাত্রিক। তবে অভাব, সঙ্কট এবং ক্ষমতাহীনতা ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎস। ধর্ম আসলে নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয় এবং মানুষের জন্য আফিম। যা কাল্পনিক সুখ দেয়। ওই কাল্পনিক সুখের ভিত্তিতে বেঁচে থাকার উপায় ধর্ম।” সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন রিয়াজ হাসান। তাঁর কথায়, ‘‘নাস্তিক মঞ্চ আমাদের কোনও ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জায়গা নয়। সাধারণ মানুষের জন্য এটা একটা আন্দোলন। মানুষ তার ব্যক্তিগত পরিসরে যে কোনও ধর্মাচরণ করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকতে পারে না। হাসপাতালে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই। ছাত্র-শিক্ষকের অভাবে স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ একের পর এক বহুমূল্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। নাস্তিকরা তার বিরুদ্ধে কথা বলবে। এই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে।”
এ দিন বাংলার সঙ্গে মহারাষ্ট্রেও নাস্তিক সম্মেলন হয়েছে বলে জানান উদ্যোক্তারা।