প্রয়াত রতন টাটা। —ফাইল চিত্র।
কিছু বিতর্ক মরে না! ফিরে ফিরে আসে। বারবার।
দু’মাসের ব্যবধানে প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং শিল্পপতি রতন টাটা। প্রথম জন অতীতের ভূত ঝেড়ে ফেলে, বাঁধা গৎ থেকে বেরিয়ে রাজ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্পায়নে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর সেই চেষ্টায় সহায় ছিলেন দ্বিতীয় জন। জমি আন্দোলনের জেরে সিঙ্গুর থেকে তাঁর ন্যানো গাড়ির প্রকল্প সরিয়ে নিয়েছিলেন শিল্পপতি টাটা। সংস্কারের পথিক হয়েও রাজনীতিক বুদ্ধদেব পথ হারিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের জোড়া ধাক্কায় বুদ্ধদেবের সরকারের পতন হয়েছিল।
‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান দিয়ে ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্টের বিপুল জয় পাওয়ার দিনই সিঙ্গুরে গাড়ির কারখানার ঘোষণা করেছিলেন টাটা। কারখানার জন্য সরকারি উদ্যোগে জমি অধিগ্রহণ ঘিরে সমস্যার সূত্রপাত। সেই কারখানা গুজরাতের সানন্দে টাটারা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন যখন, তখন থেকেই সিপিএম নেতৃত্ব বলে এসেছেন, এটা শুধু একটা কারখানার চলে যাওয়া নয়। বাংলা শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় এই ঘটনার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য সরাসরি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করেছিলেন স্বয়ং টাটাও। তৃণমূল অবশ্য বারেবারে দাবি করে এসেছে, তাদের আন্দোলন ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। কারখানা বা শিল্পের বিরুদ্ধে নয়। তার পরে কোর্টে তৃণমূল জিতেছে, ভোটেও মমতা জয়ী হয়েছেন। সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মালিকদের ফেরানো হয়েছে, যদিও তাতে আর ফসলের সুদিন ফেরেনি। বরং, প্রশ্নটা রয়েই গিয়েছে— শিল্পের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির সমস্যা কি এখনও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এই রাজ্য?
বর্তমানের বিতর্কে যাওয়ার আগে অতীতের পাতা এক বার উল্টে দেখা যাক। টাটার মৃত্যু-সংবাদ যেমন এসেছে ষষ্ঠীর রাতে, সিঙ্গুর থেকে তাঁর বিদায়ের ঘোষণাও হয়েছিল ১৬ বছর আগের এক পুজোয় চতুর্থীর সন্ধ্যায়। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ও শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন সেই বিকালে ঘণ্টাদেড়েকের বৈঠকে রতন ও টাটা মোটর্স কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা আরও একটু সময় নিয়ে ভাবুন। প্রয়োজনে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে টাটা মোটর্স-এর কর্মী, ঠিকাদার ও ভেন্ডরদের নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সিঙ্গুর প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা করতে গিয়ে টাটা বলেছিলেন, ‘‘আমার মাথায় যদি কেউ বন্দুক ঠেকায়, তা-ও আমি মাথা সরাব না বলেছিলাম। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ট্রিগার টিপে দিলেন!’’ বাংলার বিরোধী নেত্রী মমতাএবং গুজরাতের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ইঙ্গিত করে ‘ব্যাড এম, গুড এম’ মন্তব্যও ছিল।
কারখানা বন্ধের খবর ছড়ানোর পরে সিঙ্গুরে যখন ক্ষোভের আঁচ, এক্সপ্রেসওয়েতে টায়ার জ্বলছে, সেই সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাসে পুজোর উদ্বোধনে ছিলেন সাংসদ মমতা। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘টাটারা চলে গেলে সেটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না!’’ তাঁর অভিযোগ ছিল, ‘‘পুজোর মুখে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই সিপিএম রতন টাটাকে কলকাতায় এনে ন্যানো প্রকল্প বাতিলের কথা ঘোষণা করিয়েছে। এটা সিপিএম এবং টাটার যৌথ রাজনৈতিক উদ্যোগ।’’ মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে টাটা সিপিএমের সদস্যপদও নিতে পারেন!
সেই টাটার প্রয়াণে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু তৃণমূলের অবস্থানে কোনও পুনর্বিবেচনা এসেছে কি? দলের নেতা কুণাল ঘোষ বলছেন, কোনও পরিবর্তন আসেনি। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএমের ভুল জমি-নীতির দায় মমতাদি’র উপরে চাপালে হবে না! সিঙ্গুরে টাটাদের জমি দেওয়ার সময়ে প্রথমে জ্যোতি বসু, সিপিএমের কৃষক সভা, তার পরে বামফ্রন্টের শরিকেরা প্রতিবাদ করেছিল। তৃণমূল প্রথম নয়। আন্দোলনটা ছিল জোর করে কৃষিজমি নেওয়ার বিরুদ্ধে। টাটার বিরুদ্ধে তৃণমূল ছিল না, বিজ্ঞাপনে কার্যত সিপিএমকে সমর্থন করার আবেদন করে টাটা গোষ্ঠীই বিষয়টাতে রাজনৈতিক মাত্রা দিয়েছিল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘সিঙ্গুর না-হলেও বাংলায় টাটার অন্যান্য লগ্নি কিন্তু বন্ধ হয়নি। আর সিঙ্গুরের আন্দোলনের পরে গোটা দেশে নীতির পরিবর্তন হয়েছিল।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর পাল্টা মত, ‘‘একটা সম্পূর্ণ হতে চলা কারখানাকে বন্ধ করিয়ে তৃণমূল নেত্রী বাংলার ক্ষতি করেছিলেন, গুজরাতের জন্য ভাল হয়েছিল। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাকে কী দাম দিতে হচ্ছে, তার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের আছে কি না, জানি না!’’ বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যও মনে করেন, টাটা-বিদায়ের মূল্য বাংলাকে এখনও চোকাতে হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘একটা বড় শিল্প হলে তার সঙ্গে অনেক অনুসারী শিল্প আসতো, সেই সুযোগ আমরা হারিয়েছিলাম। কৃষিজমি নেওয়ার বিরোধিতা ছিল তবে আন্দোলনে নমনীয়তা দেখানোরও জায়গা ছিল। আমরা কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ১০ কিলোমিটার সরে এসে কারখানাটা হোক। অন্য আন্দোলনকারীরা কোনও বিকল্প দিয়েছিলেন কি?’’
সিঙ্গুর-প্রশ্নে ধর্মতলায় মমতার অনশন-মঞ্চে দেখা যেত বিজেপি নেতাদের। তার মধ্যে ছিলেন দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। টাটার প্রয়াণের পরে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তখন তাঁরা শুধু মনে করেছিলেন সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে। সেই সূত্রেই তাঁর দাবি, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে জানি, বিজেপির রাজ্য সভাপতি জলুদা (সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়) মমতাকে অনুরোধ করেছিলেন, আন্দোলনটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবেন না, যাতে কারখানাটা রাজ্য ছেড়ে চলে যায়। মমতা শোনেননি। বুদ্ধবাবুরও দোষ ছিল। তিনি যদি মমতাকে ধরে জেলে পুরে দিতেন, আন্দোলন উঠে যেত! কিন্তু উনি তখন ওঁর পার্টির ভিতরকার মারামারিতে বিপর্যস্ত।’’
আবার একটা পুজো এসেছে। ধর্মতলায় আবার একটা অনশন চলছে। বুদ্ধদেব প্রয়াত, বিদায় নিলেন টাটাও। তবু প্রশ্ন ও তর্ক থেকে গেল।
কিছু বিতর্ক মরে না!