টেটের কর্মী-শিক্ষকদের দিকে আঙুল

প্রশ্ন ফাঁস নয়, কর্তাদের মতে সাইবার অপরাধ

শিক্ষা দফতর বা পুলিশ আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও তদন্ত শুরু করেনি। তবে রবিবার পরীক্ষা শুরুর কিছু আগে টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট বা টেটের প্রশ্নপত্র যে বাইরে চলে গিয়েছিল, শিক্ষা দফতরের কর্তারা তা স্বীকার করে নিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বাসিন্দা উদয় সাহার ২০১২ সালের আ্যাডমিট কার্ডের রোল নম্বর আর এ বারের রোল নম্বর মেলেনি। তাই রবিবার টেটে বসতে পারলেন না তিনি। ছবি: বাপি মজুমদার

শিক্ষা দফতর বা পুলিশ আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও তদন্ত শুরু করেনি। তবে রবিবার পরীক্ষা শুরুর কিছু আগে টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট বা টেটের প্রশ্নপত্র যে বাইরে চলে গিয়েছিল, শিক্ষা দফতরের কর্তারা তা স্বীকার করে নিয়েছেন। যদিও তাঁরা এটাকে ‘ফাঁস’ বলতে রাজি নন। তাঁদের মতে, যা হয়েছে, সেটাকে ‘সাইবার অপরাধ’ বলা যেতে পারে।

Advertisement

সেই অপরাধের উৎস খুঁজে বার করা যে দরকার, সেই তাগিদ দেখা যাচ্ছে না সরকারি মহলে। পরীক্ষার ২৪ ঘণ্টা পরে, সোমবারেও এই নিয়ে ওই মহলে কোনও নড়াচড়া দেখা যায়নি। একাধিক সরকারি কর্তার দাবি, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র কোনও পরীক্ষার্থীর হাতে যায়নি। পরীক্ষা শুরুর কিছু আগে প্রশ্নের প্রতিলিপি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাইরে চলে গিয়েছে। এবং এই কাজ করেছেন সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে কর্তব্যরত কোনও কর্মী বা শিক্ষক। তাঁদেরই কেউ মোবাইলে ছবি তুলে তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমের কাছে।

যদি তেমনই কিছু হয়ে থাকে, তদন্ত হচ্ছে না কেন?

Advertisement

সরকারের এক শীর্ষ কর্তা জানান, মহালয়া থাকায় সোমবার কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে সরকার কোনও আইনি পদক্ষেপ করবে কি না, করলে কার বিরুদ্ধে, কী ধরনের অভিযোগ আনা হবে— আজ, মঙ্গলবার সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগ ওঠায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য রবিবার বলেছিলেন, ‘‘এটা প্রশ্ন-ফাঁসের ঘটনা নয়। যে যাঁকে (ওই প্রশ্ন) পাঠিয়েছেন, তাঁদের দু’জনকেই গ্রেফতার করা উচিত।’’

বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, পর্ষদ-সভাপতি এই ঘটনা নিয়ে তদন্তের ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকলে অভিযোগ দায়ের করলেন না কেন? অবশ্য সেটা করলেও বিশেষ লাভ হবে বলে মনে করেন না সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘তদন্ত কে করবে? এই পুলিশ-প্রশাসন? যারা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মতো পদে থাকা লোককে সরতে বাধ্য করায়, ভুটানে থেকেও অস্থায়ী কমিশনার ঠিক করে ফেলতে পারে, তাদের পুলিশ-প্রশাসন কী তদন্ত করবে?’’

প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগ তুলে বিরোধীরা এ দিনও পরীক্ষা বাতিল করার দাবি জানান। তাঁদের অভিযোগ, অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন বিক্রি করা হয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেন, ‘‘টেটের প্রশ্ন কালোবাজারি হয়েছে। আমরা আগেই এই পরীক্ষা বাতিলের দাবি তুলেছি। এ বিষয়ে আমরা আদালতে এবং আদালতের বাইরে, বিধানসভায় এবং বিধানসভার বাইরে লড়াই করব। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’

১২টি বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের তরফে জামির মোল্লা এ দিন দাবি করেন, ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টেট সংক্রান্ত বিভিন্ন কেলেঙ্কারির উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হোক এবং গোটা দুর্নীতির দায় নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ও শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করুন। এই দাবিতে তাঁরা আদালত ও রাজ্যপালের দ্বারস্থ হবেন বলে জানান জামির। টেট কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র লিগ এবং যুব লিগ এ দিন চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ এবং বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মোড় অবরোধ করে।

রবিবারের টেট বাতিল এবং গোটা ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবিতে বিজেপির এক দল প্রতিনিধি সোমবার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করেন। টেটের প্রশ্নপত্র বিক্রির অভিযোগের ব্যাপারে সিপিএমের সূর্যবাবুর সুরে সুর মিলিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘টেটের প্রশ্ন বিক্রি করা হয়েছে। এতে তৃণমূল জড়িত। তারা ওই ভাবে নির্বাচনের টাকা তুলেছে। আমরা শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।’’

বিরোধী শিবিরের সম্মিলিত মুখরতার মুখে পুলিশ ও সরকারি কর্তারা প্রশ্নপত্র বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। ওই কর্তাদের বক্তব্য, প্রাথমিক তদন্তে তাঁদের মনে হয়েছে, মূল প্রশ্নের সঙ্গে বাইরে চলে আসা প্রশ্নের মিল আছে। তবে যে-ভাবে সেটি বাইরে এসেছে, তাকে ‘সাইবার অপরাধ’ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। তাই সরকার কোনও পদক্ষেপ করলে তা সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত আইনেই করা হবে।

রবিবার সারা রাজ্যে টেট দেন কয়েক লক্ষ প্রার্থী। পরীক্ষা দিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। তবে সারা দিন ধরে প্রশ্ন-ফাঁসের অভিযোগটি সব কিছুকেই ছাপিয়ে যায়। ওই দিন পরীক্ষা শুরুর আধ ঘণ্টা আগে এবিপি আনন্দের অফিসে প্রশ্ন লেখা একটি কাগজ এসে পৌঁছয়। প্রশ্নপত্রের ধাঁচে পাওয়া ওই কাগজের প্রতিলিপি গড়িয়াহাট থানায় জমা দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়। থানা সেটি পাঠিয়ে দেয় শিক্ষা দফতরের কাছে। এবিপি আনন্দের তরফে সেটির প্রতিলিপি পাঠানো হয় শিক্ষাসচিবের কাছেও।

এই ঘটনা নিয়ে পুলিশ বা শিক্ষা দফতর আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও তদন্ত শুরু না-করলেও প্রশাসনের তরফে প্রাথমিক খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। এবং তাতেই আসলের সঙ্গে ওই কাগজের প্রতিলিপির অনেক মিল পাওয়া গিয়েছে বলে জানান শিক্ষা দফতরের একাধিক কর্তা। তবু একে প্রশ্ন-ফাঁস বলতে রাজি নন কর্তারা। তাঁদের যুক্তি, প্রথমত, প্রশ্ন ফাঁস হলে তা পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে যেত। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। দ্বিতীয়ত, হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। এবং এর উত্তর জেনে বহু পরীক্ষার্থী উপকৃত হয়েছেন— এমন তথ্যও নেই। তৃতীয়ত, মূল প্রশ্নপত্রের কোনও প্রতিলিপি (হার্ড কপি) মেলেনি। পুলিশ ও শিক্ষা দফতরের কাছে যা পাঠানো হয়েছে, তা হোয়াটসঅ্যাপে আসা তথ্যের প্রতিলিপি। তাই পরীক্ষা হয়েছে নির্বিঘ্নে। কোথাও কোনও অভিযোগ নেই।

নবান্নের এক কর্তা জানান, সংবাদমাধ্যম থেকেই প্রশ্নপত্র প্রকাশ্যে এসেছে। তাই সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত আইনের ফাঁসে সংবাদমাধ্যমকেই জড়ানো হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, গড়িয়াহাট থানার তরফে এবিপি আনন্দের সাংবাদিকদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু নবান্নকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন,, ‘‘হিম্মত থাকলে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে দেখাক সরকার!’’

এ দিন নাকতলায় এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘টেট শান্তিতে মিটে গিয়েছে। কিন্তু এই নিয়ে পরীক্ষার্থীদের থেকে সাংবাদিকদেরই বেশি মাথাব্যথা! টেট নিয়ে কোনও কথা বলব না। এটা আমাদের এজেন্ডার মধ্যে পড়ে না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement