ক্ষমাপ্রার্থনা করে দলকে স্রেফ একটা চিঠি! আর তাতেই পার পেয়ে গেলেন তৃণমূলের অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল! তাপসের চিঠিতে সন্তুষ্ট খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চরম অশালীন ও উস্কানিমূলক মন্তব্য করা সত্ত্বেও তাপসকে যে গ্রেফতার করা হবে না, এমনকী রাজনৈতিক স্তরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।
যদিও বিভিন্ন মহল থেকে তাপসকে গ্রেফতার করার দাবি মঙ্গলবার আরও তীব্র হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, ওই সাংসদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দিয়ে সাংসদের মন্তব্যের ভিডিও ফুটেজও চেয়েছে তারা।
এবং মঙ্গলবারই তাপসের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের আরও একটি ভিডিও ফুটেজ সংবাদমাধ্যমের হাতে এসেছে। গত ১৪ জুন নাকাশিপাড়ার চৌমুহা গ্রামে বিরোধীদের ঘরে তৃণমূলের ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করানোর হুমকি দেওয়ার দিনই তেহট্টের গোপীনাথপুর গ্রামে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “যারা মানুষকে খুন করে, তারা মানুষ হতে পারে না। ওর মা কুকুরের সাথে শুয়েছিল।... এই সিপিএমের বাচ্চা যারা, তাদের ছাড়বেন না। যত দিন তাপস পাল আপনাদের সঙ্গে আছে, তত দিন কোনও সিপিএমের বাচ্চাকে ছাড়বেন না।... মেয়েদেরও একটা কথা বলছি, বঁটি চেনেন?.. আপনারা বঁটিটা দিয়ে পারলে কেটে দিন নলিটা।”
(ঘটনাচক্রে সোমবারই বাঁকুড়ার মন্যাডি গ্রামে গিয়ে বিজেপি কর্মীদের বঁটি দিয়ে কেটে ফেলার নিদান দিয়ে এসেছেন বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি, তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী। বিরোধীদের ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে তৃণমূল কর্মীদের তিনি বলেছেন, “শোন তোর ঘরে যদি কোনও ব্যাটা ঢোকে, কেটে দিবি। আমি বুঝে নেব।”)
কৃষ্ণনগরের সাংসদ অবশ্য নলি কাটার পরামর্শেই থামেননি। তাঁর আরও মন্তব্য, “উদোম কেলান কেলাব আমি বলে রাখছি। আমি একটা মাল ছেলে কিন্তু। আমি স্ট্রেটওয়ে বলে যাচ্ছি সবার সামনে, টাঙ্গি দিয়ে মাথা কিন্তু অর্ধেক করে দিয়ে যাব। আমিও ছ’টা গুলি চালাব আমার রিভলভার থেকে...। কারও বাবার যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে আটকে দেখাবে সে।”
তাপসের নতুন ফুটেজ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের এক শীর্ষ নেতা এ দিন বলেন, “তাপস ইতিমধ্যেই ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না তা দল ঠিক করবে।” এর ঘণ্টা তিনেক পরেই অবশ্য ডায়মন্ড হারবারে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাপসের বিরুদ্ধে আইনগত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উত্তেজিত মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি কি ওকে খুন করব?” (মমতার ভাষায়: ‘আই কিল হিম?’)
তা হলে তাপসের ব্যাপারে কী করা হবে? বিশেষ করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় যখন দাবি করছেন, দলীয় সাংসদের আচরণে মমতা গভীর ভাবে শোকাহত এবং মর্মাহত! তাপসের ক্ষমাপ্রার্থনাতেই যে বিষয়টি চুকেবুকে যাবে, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “এটা শুধু ছোট ভুল (মিসটেক) নয়। এটা চরম ভুল (বিগ ব্লান্ডার)। ওকে নিন্দা (কনডেম) করা হয়েছে। নিঃশর্ত ক্ষমা (আনকন্ডিশনাল অ্যাপোলজি) চাইতে বলা হয়েছে।”
ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিতে তাপস বলেছেন, “নির্বাচনী প্রচারের তাপ-উত্তাপের মধ্যে আমার বলা কিছু কথা আপনাদের বিচলিত করেছে। ...এই জাতীয় কুকথা বলে আমি... ছোট করেছি আমার দল তৃণমূল কংগ্রেসকে। আমার কোনও অজুহাত দেওয়ার নেই।... কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আর কখনও এ রকম ঘটবে না।... আমি নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।”
তাপস ‘নির্বাচনী প্রচারের তাপ-উত্তাপের’ যুক্তি দিলেও এই সব অশালীন মন্তব্য তিনি করেছেন দিন পনেরো আগে। যার এক মাস আগে লোকসভা ভোট মিটে গিয়েছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, শুধু চৌমুহা বা গোপীনাথপুর নয়, সে দিন নাকাশিপাড়া ও তেহট্টের পাঁচ-পাঁচটি গ্রামে গিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন তাপস। প্রথমে হরনগরে নিহত এক তৃণমূলকর্মীর স্মরণসভায় গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি। এর পর একে একে চৌমুহা, গোয়ালচাপপুর, তেঘরি এবং গোপীনাথপুরে সিপিএম কর্মীদের কুপিয়ে বা গুলি করে খুন এবং ধর্ষণ করার হুমকি দেন তৃণমূল সাংসদ। সে দিন আগাগোড়া তাঁর সঙ্গে ছিল পুলিশের পাইলট কার।
পুলিশের সামনেই সাংসদ হুমকি দিলেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সংবাদমাধ্যমকে দুষে বলেছেন, “এটা এক মাস আগের ঘটনা। আপনারা তখন তো ব্যাপারটা সামনে আনতে পারতেন। পুলিশ সুয়ো মোটো মামলা করতে পারত। আমিও অনিল বিশ্বাস (সামলে নিয়ে নিজেই বলেন, অনিল বসু), সুশান্ত ঘোষদের ব্যাপারগুলো সামনে আনতে পারতাম।” দেরিতে বিষয়টি সামনে আসায় পুলিশ কিছু করতে পারল না, এমনই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী!
তাঁরা বলেন। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অবশ্য রাজ্যের কাছে জানতে চেয়েছে, তাপস পালের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর নির্ভয়ার ঘটনার পর কেন্দ্র যখন ধর্ষণ-বিরোধী আইন এনেছে, তখন কী ভাবে এক জন জনপ্রতিনিধি প্রকাশ্যে ওই ধরনের কথা বলেন, তাও রাজ্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তৃণমূল সাংসদকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশনও। কমিশনের চেয়ারপার্সন মমতা শর্মা বলেছেন, “যত দ্রুত সম্ভব তাপস পালকে গ্রেফতার করা উচিত। সাংসদ পদ থেকে ওঁকে সরিয়ে দেওয়াটাও জরুরি। আমরা বিষয়টি নিয়ে পুলিশি পদক্ষেপ করার জন্য রাজ্যকে সুপারিশ করব।” রাজ্য মহিলা কমিশনও তাপসকে গ্রেফতার করার দাবি সমর্থন করেছে। চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি, দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নিন।”
কিন্তু তাপসের ব্যাপারে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের এ দিন কোনও হেলদোল ছিল না। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা জানান, সাংসদের বক্তব্য খতিয়ে দেখা হয়েছে। তিনি নির্দিষ্ট করে কারও বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ফলে কোনও ফৌজদারি বিধিতে তাঁকে অভিযুক্ত করা যাচ্ছে না। বক্তব্যগুলি অত্যন্ত আপত্তিকর হলেও যে হেতু সাধারণ ভাবে বলা হয়েছে, তাই এখনই কিছু করা হচ্ছে না। দিল্লির রিপোর্ট চাওয়া প্রসঙ্গে ওই কর্তা বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানতে চাইলে সরকার এই বক্তব্য জানিয়ে দেবে। সাংসদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও অভিযোগ হয়নি। কোনও অভিযোগ হলে তার তদন্তও হবে।”
‘ক্ষমার চিঠি’...সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...
মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়েরও মত, তাপসের বক্তব্য প্ররোচনারই সামিল। তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “এ তো সামাজিক ব্যাধি। আইন দিয়ে জোর করে কি তা দূর করা সম্ভব? আজ সাংসদকে গ্রেফতার করলেন। কাল জেল থেকে বেরিয়ে উনি একই কথা বলবেন না তার নিশ্চয়তা কী?”
কলকাতার আর এক প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার সুজয় চক্রবর্তীর মন্তব্য, “আমরা যাকে ভয় দেখানো বলি, উনি তো তা-ই করেছেন। ফলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করাই যায়।”তাপস সাধারণ ভাবে মন্তব্য করেছেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়, নবান্ন-কর্তার এই যুক্তি মানতে নারাজ প্রাক্তন পুলিশ কর্তা এবং আইনজ্ঞরা। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর এত দিন বাদে যদি পুলিশ অফিসারদের প্ররোচনায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তা হলে এ ক্ষেত্রে সাংসদ যা বলেছেন, তাতেও তো প্ররোচনা রয়েছে। তাঁর কথায়, “আগামী কিছু দিনের মধ্যে ওই এলাকার কোথাও যদি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, বা কেউ খুন হয়ে যান, তা হলে তো সাংসদের বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ আনা যেতে পারে।”