তপন ঘোষ (বাঁ দিকে, মাঝখানে)। ছবি: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য
গড়বেতার ময়রাকাটা লাইন। জাতীয় সড়ক লাগোয়া দোকানে চেয়ার পেতে বসেছেন তিনি। সাদা জামার বুক পকেটে পেন, মোবাইল ফোন। তাঁকে ঘিরে এখনও সর্বক্ষণ ঘোরে চার-পাঁচ জন। বললেন, ‘‘আমি বড় নেতা নই। তবে আমিই এই রাজ্যের প্রথম হার্মাদ! ছোট আঙারিয়া মামলায় আমাকেই হার্মাদ বানানো হয়েছিল...!’’
পাশেই লোহা পেটাইয়ের কাজ চলছে। প্রবল বিরক্তিতে কথা থামালেন গড়বেতার এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা তপন ঘোষ। দোকানের মালিককে ডেকে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেন। কথা বলা যাচ্ছে না! দোকান-মালিক বলেন, ‘‘কাজ বন্ধ রাখলে তো পেট চলাও বন্ধ হয়ে যাবে দাদা!’’ নেতা এবার বললেন, ‘‘চা, পাঁপড় পাঠাচ্ছি। শ্রমিকদের না খাইয়ে কাজ করাতে নেই। ওঁরা খেয়ে নিন, আমিও কথা বলে নিই!’’
গড়বেতার স্থানীয়েরা বলেন, এখনও তপনের প্রভাব এতটা যে, তাঁর নির্দেশ অমান্য করা চলে না। তাঁর সঙ্গেই এক ডাকে উচ্চারিত হওয়া নাম: সুকুর আলি, সুশান্ত ঘোষেরা পালাবদলের পরে সে ভাবে এলাকায় ভিড়তে না পারলেও তিনি রয়েছেন বহালতবিয়তে। গত লোকসভা ভোটের পরে এখন তাঁর উপরে ভর করেই গড়বেতার হারানো জমি পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে সিপিএম। তাঁদের ব্যাখ্যা, গত লোকসভা নির্বাচনে গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৬ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তবে এলাকায় তাদের তেমন কোনও সংগঠন নেই। তৃণমূলের উপরে রোষে মুখ ফেরানো ভোটারদের নিজেদের দিকে টানাই তাঁদের পরিকল্পনা।
এখানেই ছিল মাটির দোতলা বাড়ি, যা জ্বালানোর অভিযোগ ওঠে, দেখাচ্ছেন বক্তার। —নিজস্ব চিত্র
কিন্তু গড়বেতা বাজারের কাঠের ব্যবসায়ী সমীর ঘোষ বললেন, ‘‘সিপিএম-কে যাঁরা এতদিন ভোট দিতেন, তাঁরাও এবার তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। সিপিএমকে দিলে তৃণমূল-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাবে বলে ভেবেছেন তাঁরা।’’
গত পঞ্চায়েত ভোটে গড়বেতা-১ এবং গড়বেতা-২ মিলিয়ে ১৬টি গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে ১৫টি-ই তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছিল। গড়বেতা-২ এলাকার একটি মাত্র গ্রামপঞ্চায়েত পেয়েছিল বিজেপি। তার পরেও লোকসভার এই ফলাফল কেন? স্থানীয়দের অনেকেরই দাবি, গড়বেতার বেআইনি বালি খাদান, মোরামের বখরা নিয়ে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের খেয়োখেয়ি মানুষ ভাল চোখে দেখেননি। এর সঙ্গে ছিল জমির আলুর কালোবাজারির অভিযোগ।
গড়বেতার বিধায়ক আশিস চক্রবর্তীও ‘বালি নিয়ে মেতে থাকা’র জন্য বকুনি খেয়েছেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। চমকাইতলার বাসিন্দা পেশায় স্কুল-শিক্ষক স্বপন হাজরা বললেন, ‘‘আমরাই তৃণমূলকে ভোট দিয়ে এনেছিলাম। বালি, মোরাম থেকে টাকা খেতে দেখেও প্রথমে গায়ে লাগেনি। মনে হয়েছিল, যে-ই ক্ষমতায় আসে একই কাজ করে। কিন্তু, পঞ্চায়েত ভোটে ভোটটাই দিতে দিল না! যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছিলেন, তৃণমূল তাঁদের উপরে বিশ্বাস রাখেনি কেন? এ বার যখন তাঁরা ভোট দিতে পারলেন, উল্টো
দিকে দিলেন।’’
তৃণমূল বিধায়ক আশিসবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘নিচু স্তরের কিছু নেতার কাজে মানুষ রেগে গিয়েছিলেন। আমার কেন্দ্র থেকে এগিয়ে থেকেই বিজেপি যে ভাবে কালোবাজারি শুরু করেছে, তাতে মানুষ ভুল বুঝতে পেরেছেন। পরের ভোটেই এর ফল পাবে ওরা।’’ গড়বেতার বিজেপি নেতা প্রদীপ লোধার আবার দাবি, ‘‘বিজেপিই রাজ্যের ভবিষ্যৎ। তৃণমূলের দুর্নীতি আর অত্যাচার মানুষ ভুলতে পারবেন না। সিপিএমও আর ফিরবে না। ওদের অত্যাচার এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।’’
গাড়ির চালকই বলছিলেন ২০০১ সালে ছোট আঙারিয়া-কাণ্ডের কথা। ওই বছরের ৪ জানুয়ারি অন্তত ১২ জনকে পুড়িয়ে, গুলি করে মারার অভিযোগ ওঠে। পরে নিহতের সংখ্যা পাঁচজন বলে দাবি করা হয়। স্থাপিত হয় ‘পাঁচ শহিদের স্মৃতি’ স্তম্ভ। তৃণমূলনেত্রী মমতা ছোট আঙারিয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ঘটনার তদন্ত ভার নেয় সিবিআই। গ্রেফতার হন তপন এবং সুকুর-সহ আরও অনেকে। তবে এখনও কোনও দেহের হদিস মেলেনি।
ঘটনার একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী বক্তার মণ্ডল নিজের মাটির বাড়ির চৌকিতে বসে বলছিলেন, ‘‘সিপিএমের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে তপনদার কাছে যাই আমরা। উনিই সকলকে একটি বাড়িতে রাখতে বলেন। সেখানেই রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে, গুলি করে মারা হয় সকলকে! কোনওমতে বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে প্রাণে বাঁচি। মমতাদি কলকাতায় গিয়ে রেখেছিলেন আমায়।’’ তাঁর বিরুদ্ধে তো সাক্ষ্য বদল করার অভিযোগ উঠেছে? বক্তার বলেন, ‘‘আমার পরিবারকে গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সিপিএম। মমতাদি হয়তো রাগ করেছেন। কিন্তু, ওদের কথা মতো আদালতে না বললে মেরে ফেলত। ভোট আগে না প্রাণ!’’ ‘দিদি’ তাঁর থেকে মুখ ঘোরালেও বক্তার এখনও দিদির দিকে তাকিয়ে। তবে একটি ব্যাপারে তিনি কঠোর। বললেন, ‘‘যে নেতারা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে ছড়ি ঘোরান, তাঁদের মানব না।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।