(বাঁ দিকে) শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার। বুধবার সায়েন্স সিটিতে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকে। — নিজস্ব চিত্র।
রাজ্য বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারী জানিয়ে দিলেন, তিনি বিজেপির সংগঠনের কোনও দায়িত্বে নেই। তিনি শুধু রাজ্যের বিরোধী দলনেতা! যে ‘ঘোষণা’র পরে অনেকে মনে করছেন, প্রকারান্তরে শুভেন্দু লোকসভা নির্বাচন এবং সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা উপনির্বাচনে বিপুল পরাজয়ের ‘দায়’ এড়িয়ে গেলেন।
বুধবার সায়েন্স সিটিতে আয়োজিত ওই বৈঠকে শুধু রাজ্য বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব নন, হাজির ছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি এবং নেতারাও। তাঁদের উপস্থিতিতেই সংগঠনের সঙ্গে শুভেন্দুর ‘দূরত্ব’ রচনা নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই মনে করছেন, শুভেন্দুর ওই মন্তব্যে পরোক্ষে ইঙ্গিত রয়েছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দিকে। কারণ, রাজ্য সভাপতি হিসেবে সুকান্তই সংগঠনের হর্তাকর্তাবিধাতা।
একই সঙ্গে শুভেন্দু জানিয়েছেন, বাংলায় ‘গণতন্ত্র ধ্বংস’ হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলায় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আগে গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। আমরা রাষ্ট্রপতি শাসন চাই না। পিছনের দরজা দিয়ে নবান্নে ঢুকতে চাই না। আমরা বাংলায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ভোটে ওদের (তৃণমূলকে) পরাজিত করে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করব। লড়াই করব।’’
লোকসভা ভোটে দেশে তো বটেই, বাংলাতেও আসন কমেছে বিজেপির। ১৮ থেকে কমে ১২-এ এসে ঠেকেছে বাংলায় বিজেপির প্রাপ্ত আসন। ভোটের সেই ফলপ্রকাশের পরে বেশ কিছু দিন প্রকাশ্যে আসেননি শুভেন্দু। পরে নানা বিষয়ে শাসকদলকে আক্রমণ করলেও তাঁকে ‘আগের ভূমিকায়’ দেখা যায়নি বলে মনে করেন বিজেপির অনেকেই। কম কথা বলেছেন। আর যখনই বলেছেন, তখনই প্রকাশ্যে এসে পড়েছে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ক্ষোভ। বুধবার বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকেও সে কথা শোনা গেল শুভেন্দুর মুখে। একই সঙ্গে চার বিধানসভার উপনির্বাচন নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। আর তার পরেই বলেন, ‘‘আমি দলের সংগঠনের দায়িত্বে নেই। আমি বিরোধী দলনেতা।’’
তিনি ভোটের সময় কোথায় কোথায় গিয়ে প্রচার করেছেন, তা-ও উল্লেখ করেন শুভেন্দু। সবিস্তারে না-বললেও তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট যে, দল বা সংগঠনের তরফে তাঁকে যেমন প্রচারসূচি দেওয়া হয়েছিল, তিনি তা মেনেই প্রচার করেছিলেন। বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিনি তাঁর ‘কর্তব্য’ পালন করেছেন। কারণ, শুভেন্দু অতীতেও বলেছেন, ‘‘সংগঠনের নির্দেশই সব। সংগঠন আমাকে যা বলবে আমি তা-ই করব।’’ ভোট হয় মূলত সংগঠনে। সুকান্ত সম্প্রতি হুগলির দু’টি দলীয় সভায় তাঁর ভাষণে কর্মীদের বলেছিলেন সংগঠনের উপর জোর দিতে। সংগঠন মজবুত না-করলে ভোটে জেতা যায় না। ওই সভাতেই সুকান্ত ‘এজেন্সি নির্ভরতা’ নিয়ে সরব হয়েছিলেন। এ বার শুভেন্দু সেই ‘তির’ সুকান্তের দিকেই ঘুরিয়ে দিলেন বলে বিজেপির রাজ্য নেতাদের একাংশ মনে করছেন।
ঘটনাচক্রে, এর আগেও শুভেন্দু সংগঠনের সঙ্গে নিজের দূরত্ব তৈরি করেছেন। ডায়মন্ড হারবারের বিজেপি প্রার্থীকে শোকজ় করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এ সব সংগঠনের বিষয়। আর আমি বিরোধী দলনেতা।’’ বস্তুত, বিজেপির অন্দরে সংগঠন এবং পরিষদীয় দল দু’টি আলাদা ক্ষেত্র। দু’টিই নিজেদের কাজ করে। সেই অর্থে শুভেন্দু সত্যিই ‘সংগঠনের লোক’ নন। তিনি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির পরিষদীয় দলনেতা। সেই সূত্রেই বিরোধী দলনেতা। ফলে তাঁর কাজকর্ম মূলত পরিষদীয় দল নিয়েই। কিন্তু একই সঙ্গে শুভেন্দু বিজেপির অন্দরে অন্যতম ‘জননেতা’ও বটে। ফলে ভোটের সময় তাঁর ‘প্রভাব’ অনস্বীকার্য ছিল।
কিন্তু বুধবারের বক্তৃতায় শুভেন্দু নিজেকে সংগঠন থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। তা-ও এমন একটি মঞ্চ থেকে, যেখানে রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রতিনিধিরা রয়েছেন। রয়েছেন রাজ্য সভাপতি সুকান্তও। সেই সূত্রেই সংগঠনের সঙ্গে তাঁর ‘দূরত্ব’ আরও এক বার সর্বসমক্ষে জানিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে। বিজেপি সূত্রের খবর, বুধবারের কর্মসমিতির বৈঠকের আগে তার পরিকল্পনা নিয়ে মঙ্গলবার বিজেপির সল্টলেকের দফতরে যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল, সেখানেও শুভেন্দু ছিলেন না। তবে এ-ও ঠিক যে, শুভেন্দু সাংগঠনিক বৈঠকে কখনও সে ভাবে উপস্থিত থাকেন না। কারণ, তিনি বিরোধী দলনেতা। ‘সাংগঠনিক’ নেতা নন। ফলে শুভেন্দু এ ক্ষেত্রে বিজেপির যা নিয়ম, তা-ই বলেছেন। কারণ, বিজেপিতে সংগঠন এবং পরিষদীয় দল আলাদা। তবে পাশাপাশিই, বিরোধী দলনেতা সংগঠনের বাইরেও নন।