(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু অধিকারী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই সরাসরি সিপিএমকে দায়ী করেছেন। বিজেপি কিন্তু সিপিএমের কথা উচ্চারণ করেনি। মঙ্গলবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভায় বলেছেন, ‘‘যাদবপুরে উগ্র বাম সংগঠন সক্রিয়। ওটা দেশবিরোধী শক্তির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।’’
যাদবপুর প্রসঙ্গে শাসক ও বিরোধী পক্ষের দুই নেতা-নেত্রীর ভিন্ন লক্ষ্যচয়ন দেখে অনেকে মনে করছেন, অঙ্ক কষেই সবটা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর পিছনে কোন অঙ্ক রয়েছে?
যাদবপুরের ঘটনার পর ১৪ অগস্ট বেহালার একটি সভা থেকে মমতা বলেছিলেন, ‘‘যাদবপুরের ছেলেটাকে মেরেছে মার্ক্সবাদীরা। ওখানে কিছু আগমার্কা সিপিএম আছে। তারা ছেলেটার জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়েছিল। একটা গামছা জড়ানো ছিল। সেটাও হয়তো পরে কেউ পরিয়ে দিয়েছিল।’’ সেই প্রথম মমতা যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন। কেন মমতা সিপিএমের কথা বললেন, তা নিয়ে গোড়ায় কিছুটা ধন্দে ছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও। কিন্তু সোমবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম, মোয়াজ্জেমদের সম্মেলনে মমতা ফের বলেন, ‘‘যাদবপুরে সিপিএমের ইউনিয়ন ছেলেটাকে মেরে দিয়েছে।’’
নেতা-নেত্রীরা বিনা কারণে কখনও কিছু বলেন না। সব সময়েই তার পিছনে কারণ এবং উদ্দেশ্য থাকে। মমতা তার ব্যতিক্রম নন। যেমন ব্যতিক্রম নন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুও। প্রশ্ন হল, কে কী বলছেন। কেন বলছেন।
তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘বামপন্থীদের, বিশেষত কমিউনিস্টদের অত শাখাপ্রশাখা মানুষ বোঝেন না। তাঁরা বাংলায় বাম বলতে সিপিএমই বোঝেন। সেই অর্থেই দিদি কথাটা বলেছেন।’’ শুভেন্দুরা আবার যাদবপুরের ছাত্রদের সঙ্গে উগ্র বাম, মাওবাদী-যোগের কথা বলেছেন। অনেকের মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা সে কথা বলতে পারবেন না ‘প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতা’ থেকেই। তিনি যদি বলেন, যাদবপুরের ঘটনাটির সঙ্গে মাওবাদী সংযোগ রয়েছে, তা হলে তাঁর মাওবাদী সংক্রান্ত বয়ান নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলার অবকাশ পাবে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন, এখন বাংলায় মাওবাদী বলে কিছু নেই!
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পূর্বাঞ্চলীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে শেষ বার যখন নবান্নে এসেছিলেন, তখনও বৈঠকেরও মূল আলোচ্য ছিল পূর্ব ভারতে নকশালপন্থা দমন। সেখানেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়েছিল, এ রাজ্যে নকশালপন্থী বা মাওবাদীদের দৌরাত্ম্য নির্মূল করা গিয়েছে। ঘটনাপ্রবাহও বলছে, বাম জমানার শেষ পর্বে জঙ্গলমহল যে ভাবে মাওবাদীদের হাতে চলে গিয়েছিল, মমতা ক্ষমতায় আসার পরেই তা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিলেন। প্রশাসনিক অভিযানের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে রাস্তাঘাট, পানীয় জল, আলো— মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়নের মৌলিক কাজগুলিতে গুরুত্ব দিয়েছিল মমতা সরকার।
তৃণমূলের একটি অংশ অনুমান করছে, সিপিএমের নাম বলে সামগ্রিক রাজনীতির নিরিখে বাম আমল এবং বাম রাজনীতির ‘নৃশংসতা’কে বোঝাতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
তবে শুভেন্দু তথা বিজেপি যাদবপুরকাণ্ডে উগ্র বাম ও মাওবাদীদের কথা বলছেন। কেন তিনি সিপিএমকে জুড়ছেন না বা জুড়তে চাইছেন না? অনেকের মতে, শুভেন্দু জানেন, সিপিএমের ভোট লোকসভায় তাঁদের দিকে না গেলে প্রস্তাবিত আসনসংখ্যায় বড় গোলমাল হয়ে যেতে পারে। ২০১৯-এর লোকসভার ফলাফলে সাদা-কালোয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বামের ভোট রামের বাক্সে যাওয়াতেই বিজেপি উল্কার গতিতে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট চার শতাংশ থেকে প্রায় ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। একই অনুপাতে ভোট কমেছে গেরুয়া শিবিরের।
এই বিষয়টিও শুভেন্দুদের কাছে ‘উদ্বেগজনক’ বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট মহলের। অনেকের বক্তব্য, সেই অবস্থান থেকেই সিপিএমের ভোটারকুলকে চটাতে চাইছেন না নন্দীগ্রামের বিধায়ক। পাশাপাশি উগ্র বাম এবং মাওবাদীদের কথা বলে ‘প্রশাসক’ মমতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন বিরোধী দলনেতা। সঙ্গে পরিমাণমতো জাতীয়তাবাদী আবেগও উস্কে দেওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই গীতা মুখোপাধ্যায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতাদের সম্পর্কে স্তুতি শোনা যাচ্ছে বিজেপি নেতাদের গলায়। শুভেন্দুর মতোই দিলীপ ঘোষেরাও নিশানা করছেন র্যাডিক্যাল বামপন্থী শক্তিকে। সেই বন্ধনীতেও কোথাও সিপিএমকে রাখছেন না গেরুয়া শিবিরের নেতারা।
বঙ্গ সিপিএম অবশ্য মমতা-শুভেন্দুকে এক বন্ধনীতে রেখেই আক্রমণ শানিয়েছে। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘যাদবপুরকোণ্ডে যারা ধরা পড়েছে, তাদের কে সিপিএম, কে এসএফআই? তারাই ধরা পড়েছে, যাদের পূর্বসূরিরা মমতা-শুভেন্দুর দানাপানি খেয়ে সিপিএম নিকেশ করতে গিয়েছিল জঙ্গলমহলে।’’ অনেকের মতে, বাংলায় সিপিএমের এখন যা সাংগঠনিক অবস্থা তাতে এ ছাড়া অন্য কিছু বলারও নেই সেলিমদের। তবে মমতার সিপিএমকে নিশানা করা এবং শুভেন্দুদের সে পথে না হাঁটার মধ্যে সুস্পষ্ট অঙ্ক রয়েছে বলেই সাধারণ অভিমত।