‘বিজেপি থেকে পদত্যাগ তো করিনি, কিন্তু...’

আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কী বললেন শোভন চট্টোপাধ্যায়?

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২০ ১৬:৩০
Share:

ফের শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে তুঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতা।

তিনি কখনও দিল্লিতে গিয়ে বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নেন। আবার কখনও ভাইফোঁটা নিতে পৌঁছে যান তৃণমূলনেত্রীর বাড়িতে। কখনও তাঁর বাড়িতে ছুটে যান বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা। কখনও আবার খবর আসে, তাঁকে দলে ফেরাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ফোন করেছেন। মাসের পর মাস ধরে জল্পনা অতএব তুঙ্গে থাকে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোভন কিন্তু জল ঢেলে দিলেন তৃণমূলে ফেরার জল্পনায়। সক্রিয় থাকুন বা না থাকুন, বিজেপি যে তিনি ছাড়েননি, সে ইঙ্গিতও খুব স্পষ্ট ভাবেই দিলেন। তা হলে কি গেরুয়া পতাকা হাতে নিয়ে মাঠে-ময়দানে জলদিই দেখা যাবে তাঁকে? এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু ঝুলিয়েই রাখলেন শোভন।

Advertisement

২০১৯-এর অগস্টে বিজেপিতে যোগদান। তার পর দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তা। ঠিক এক বছর বাদে ২০২০-র অগস্টে ফের শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে তুঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ফোনে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে খবর এল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে প্রায় সর্ব ক্ষণের কর্মী হিসেবে ‘মিশন কানন’-এ নামিয়ে দেওয়া হল। আচমকা খবর ছড়াল যে, শোভনের ওয়ার্ডে তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে শোভনের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে (সে খবরকে তৃণমূলের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউ অবশ্য মান্যতা দেননি)। তৃণমূলে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করতেই রত্নাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূলের একাংশ দাবি করতে শুরু করল।

পাল্টা তৎপরতা দেখা গেল গেরুয়া শিবিরেও। রত্নার ‘অপসারণের’ খবর যে দিন সামনে এল, সে রাতেই ফোনে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেশ লম্বা আলোচনা সেরে নিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। শোভনের গোলপার্কের ফ্ল্যাটে ছুটলেন দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক তথা বাংলার সহকারী পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন। আড়াই ঘণ্টার বৈঠক সেরে গভীর রাতে বেরলেন অভিজাত আবাসন থেকে।

Advertisement

কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং অরবিন্দ মেননের সঙ্গে এই দফার কথা সেরে তাঁরা যে অনেকটাই সন্তুষ্ট, সে ইঙ্গিত শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় দিতে শুরু করেছেন গত কয়েক দিন ধরেই। তা হলে কি টানাপড়েনে ইতি? ঘাসফুল, নাকি পদ্মফুল— এ প্রশ্নের কি আর কোনও অবকাশ নেই? তৃণমূল চ্যাপ্টার কি ক্লোজড? এই সব প্রশ্নই ভেসে বেড়াচ্ছিল রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে সব প্রশ্নের জবাব আগের চেয়ে অনেকটা স্পষ্ট ভাবেই দিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন জেড প্লাস মন্ত্রী।

বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সেই মুহূর্ত

‘‘২০১৮-র নভেম্বরে রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে এবং কলকাতার মেয়র পদ থেকে আমি ইস্তফা দিই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক বিষয়ে বাক্যালাপ করার কোনও সুযোগ আমি তৃণমূল নেতৃত্বকে দিইনি। কেউ কেউ হয়তো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমি অবকাশ দিইনি,’’— বলছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, গত এক বছরে তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর কোনও রকম রাজনৈতিক যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেও তো মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সনের বাড়ি গিয়ে ভাইফোঁটা নিয়েছেন শোভন। মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কখনও চলচ্চিত্র উৎসবে, কখনও ইডেন গার্ডেনসে হাজির হয়েছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে। শোভন বলছেন, এগুলোর একটাও কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ছিল। ওই সব অবকাশে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে, কিন্তু একটাও রাজনৈতিক ক‌থা তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর হয়নি বলে শোভন জানাচ্ছেন।

শোভন না হয় অবকাশ দেননি। কিন্তু তৃণমূলও কি গত এক বছরে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেনি? ভাইফোঁটা বা চলচ্চিত্র উৎসবের আসরে না হয় রাজনৈতিক কথা হয়নি। কিন্তু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যে নবান্নে তলব পেলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যে একান্ত কথোপকথন হল, সে সবই কি নেহাৎ ‘সৌজন্য বিনিময়’ ছিল? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, প্রয়োজনে পার্থর বাড়িতে বা বিকাশ ভবনে গিয়ে বৈশাখীর বৈঠক, সে সবে কোনও রাজনীতি ছিল না? চলতি মাসেই বেশ কয়েক বার মুখ্যমন্ত্রী নিজে বৈশাখীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বলে যে দাবি শোভন চট্টোপাধ্যায় করছেন, সেই কথোপকথনেও কোনও রাজনীতি নেই?

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত, মৃত্যুর নিরিখে বিশ্বে তৃতীয় ভারত

এ বার কৌশলী জবাব সাড়ে তিন দশকের পোড় খাওয়া রাজনীতিকের। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় যে সব আলোচনা চালিয়েছেন, তা যে রাজনৈতিকই, সে কথা শোভন মানছেন। তবে সে প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন তিনি। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব যখন বৈশাখীর সঙ্গে নানা আলোচনা চালাচ্ছেন, তখন তৃণমূলেরই কোনও এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমের সামনে বৈশাখীকে শোভনের ‘স্বঘোষিত মুখপাত্র’ আখ্যা দিয়ে কটাক্ষ করছেন কেন? প্রশ্ন শোভনের। তাঁর কথায়, ‘‘বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহু বার পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফোন করেছেন। নবান্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ফোন করেছেন। নবান্নে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বহু বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করেছেন, আমি দেখেছি, বহু কথাবার্তা হয়েছে। যখন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাবার্তা হচ্ছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথাবার্তা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমাকে নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। অর্থাৎ তাঁরা আলোচনা করছেন। কিন্তু এর পাশাপাশিই সংবাদমাধ্যমে তৃণমূলেরই এক মুখপাত্র বলছেন, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্বঘোষিত মুখপাত্র!’’ বিস্ময় প্রকাশ করছেন শোভন। বলছেন, ‘‘যখন সর্বোচ্চ নেতৃত্ব আলোচনা চালাচ্ছেন, তখন দলের মুখপাত্রদেরকেও সেটা জানানো উচিত ছিল। ভিতরে ভিতরে এক রকম কথা চালানো হচ্ছে, প্রকাশ্যে আর এক রকম কথা বলা হচ্ছে।’’

তা হলে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে শোভনের বক্তব্যের নির্যাস কী? নির্যাস হল— ২০১৮-র ২২ নভেম্বরের পর থেকে তৃণমূলের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক যোগসূত্র তাঁর নেই। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কয়েক বার সৌজন্য বিনিময় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক কথা বলার অবকাশ তিনি তৃণমূলের কারওকে দেননি। তৃণমূল নেতৃত্ব বরং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু সে কথোপকথনেও তিনি সদিচ্ছা দেখতে পাননি, কারণ তৃণমূল নেতৃত্ব ভিতরে ভিতরে এক রকম কথা বলেছেন, প্রকাশ্যে অন্য রকম মন্তব্য দেখা গিয়েছে।

শোভনের এই বক্তব্যে কিন্তু স্পষ্ট যে, তৃণমূলের প্রতি তিনি কতটা বিরক্ত এবং তিক্ততা কতটা তীব্র। কিন্তু তিক্ততা যদি এতই হবে, তা হলে বার বার তাঁর তৃণমূলে ফেরার জল্পনা কেন ভেসে উঠবে? শোভন বলছেন, ‘‘এই জল্পনা যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁরা কারা, তাঁরা কেন এ সব করছেন, এটার খুব ভাল ব্যাখ্যা তাঁরাই দিতে পারবেন।’’

তা হলে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে শোভনের বক্তব্যের নির্যাস কী? কী বলছেন তিনি? দেখুন ভিডিয়ো

আর বিজেপি প্রসঙ্গে কী বলছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। ২০১৯-র ১৪ অগস্ট দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে দাঁড়িয়ে যে তিনি গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সে কথা ফের মনে করিয়ে দিচ্ছেন শোভন। সে দিন কাদের উপস্থিতিতে তিনি দলে যোগ দিয়েছিলেন, সে সবও তুলে ধরছেন। কিন্তু এখনও কি বিজেপিতে রয়েছেন? স্বভাবসিদ্ধ কৌশলী ভঙ্গিতে শোভনের মন্তব্য, ‘‘আমি তো লিখিত ভাবে কোনও পদত্যাগপত্র এই মুহূর্ত পর্যন্ত পাঠাইনি বা পাঠানোর অবকাশও হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্ত কথা ওঠা অবান্তর।’’

অর্থাৎ বেহালা পূর্বের বিধায়ক বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি বিজেপিতেই রয়েছেন। দলে থেকেও কেন দলের হয়ে সক্রিয় হননি, সে ব্যাখ্যাও নিজে থেকেই দিলেন তিনি। শোভন বললেন, ‘‘দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার পরে অনভিপ্রেত কিছু কিছু ঘটনার জন্য অহেতুক একটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে। তাই বিজেপির কোনও কর্মসূচিতে আমার যোগ দেওয়া হয়নি।’’ শোভনের কথায়, ‘‘আমরা রাজনীতির মানুষ, আমরা রাজনৈতিক ভাবে চলাফেরা করি। যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়াই উচিত ছিল। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে আমি নির্দিষ্ট ভাবে বলেছিলাম, ভবিষ্যতে যাঁরা আসবেন আপনাদের কাছে, তাঁদের যেন এই রকম পরিবেশের মুখোমুখি হতে না হয়।’’

রায়দিঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ের বিজেপিতে যোগদানের চেষ্টা, সে নিয়ে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে শোভন-বৈশাখীর টানাপড়েন— এ সবের জেরে বিজেপিতে যোগ দিয়েও কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন শোভনরা। এ রাজ্যের কয়েক জন বিজেপি নেতার কিছু কিছু মন্তব্য ‘অনভিপ্রেত’ ছিল এবং ‘অহেতুক বিড়ম্বনা’ বাড়িয়েছিল বলেও শোভন মনে করেন। সে সবের জেরেই সক্রিয় ভাবে দলের হয়ে মাঠে নামা হয়নি, কিন্তু তা বলে বিজেপির সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি— এই রকম বার্তাই শোভন চট্টোপাধ্যায় বেশ স্পষ্ট ভাবে দিতে চাইছেন এখন। তিনি বলছেন, ‘‘আমি নিজে এই বছরখানেকের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। বিশেষ করে অরবিন্দ মেনন। এখানে এসেছেন, কথাবার্তা হয়েছে, আমাদের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। বহু গল্প হয়েছে।’’

আরও পড়ুন: উৎসবের দিনে ‘দো গজ কি দূরি, মাস্ক জরুরি’, ‘মন কি বাত’-এ বার্তা মোদীর

বাড়িতে কোনও নেতার একাধিক বার আসা বা ‘বহু গল্প’ হওয়া কি দলে থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দেয়? বহু কথা তো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও হয়েছে, বার বার হয়েছে। বাড়িতে তো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও এসেছেন। শোভন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন, সেটা ভারতীয় জনতা পার্টিতে যাওয়ার আগে।’’ শোভন বোঝাতে চাইছেন— ফোনে যতই কথা হোক, যাঁর সঙ্গেই হোক, তিনি বিজেপিতে যোগদানের পরে তৃণমূলের কোনও শীর্ষনেতাকে তাঁর বাড়িতে ঢুকতে দেখা যায়নি।

তা হলে তাড়াতাড়িই বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমে পড়তে দেখা যাবে শোভন চট্টোপাধ্যায়কে? এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায় এ বারেও দিলেন না। অরবিন্দ মেননের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টার বৈঠকের পরে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘খুব ভাল কথা হয়েছে, ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।’’ কিন্তু শোভনের ইঙ্গিত, আলোচনা ইতিবাচক হলেও সব এখনও চূড়ান্ত নয়। মেননের সঙ্গে হওয়া বৈঠক প্রসঙ্গে শোভন বলছেন, ‘‘আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, আছি। একটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আলোচনার মধ্যে বহু কিছু আসে, এসেছে। কথা হয়েছে। কিন্তু কথা কতটা পরিণত হয়েছে, তা বলার অবকাশ এখনও আসেনি।’’

অর্থাৎ তৃণমূলের হয়ে আর মাঠে নামার প্রশ্ন নেই। বিজেপির হয়ে মাঠে নামতেই পারেন, তবে কবে নামবেন, আদৌ নামবেন কি না, তা নির্ভর করছে কথাবার্তা ‘পরিণত’ হওয়ার পরে। ধরে নেওয়া যাক, কথাবার্তা ‘পরিণত’ হয়েই গেল, শোভন ময়দানে নেমেও পড়লেন। কিন্তু নিজের চেনা ময়দানটা কি আর আগের মতো মসৃণ রয়েছে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের জন্য? তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র বেহালা পূর্ব বা তাঁর খাসতালুক ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর রাজনৈতিক জমি নিঃশেষে ছিনিয়ে নিতে তো তৃণমূল সব রকম ভাবে তৎপর। যে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মনান্তরের কারণে শোভন বাড়ি ছেড়েছেন, যে রত্নাকে তৃণমূল নেতৃত্ব সমর্থন করায় তৃমমূলের সঙ্গে শোভনের দূরত্ব দিন দিন বেড়েছে, সেই রত্নাকেই তো শোভনের ওয়ার্ডের সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে রাজ্যের শাসক দল। মুখে না বললেও আসলে শোভনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়তেই যে রত্নার উত্থান ঘটানো, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সংশয় কমই। এক কালে ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডে শোভনের লোকজন হিসেবে যাঁরা পরিচিত ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এখন রত্নার আশেপাশে। সম্ভবত সেই বলে বলীয়ান হয়েই রত্না বলছেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলে ফিরলে ভাল, আমি তাঁর হয়ে খাটব। কিন্তু যদি তিনি বিজেপির হয়ে লড়তে আসেন, এখানে তাঁর জামানত আমি জব্দ করে দেব।’’

আরও পড়ুন: এসি বন্ধ, থাকবে না টোকেন, কড়া বিধিনিষেধে চলবে দিল্লি মেট্রো​

এই প্রসঙ্গেও মুখ খুলেছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘‘কে রত্না চট্টোপাধ্যায়! তাঁর কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই। পুরসভা আর বিধানসভা মিলিয়ে আমি নিজে ১০টা নির্বাচন লড়েছি। ৯টায় জিতেছি। একটাতেও রত্না চট্টোপাধ্যায়কে আমার দরকার হয়নি। বেহালায় তাঁকে পাশে নিয়ে আমাকে হাঁটতে হবে, এটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তা হলে সেটা তাঁর ভাবনা। আমার কিছু যায় আসে না।’’ রত্না চট্টোপাধ্যায় যদি এতই গুরুত্বহীন হবেন, তা হলে তাঁর অপসারণের জন্য তৃণমূলকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল কেন? রত্নাকে সরালে তবেই শোভন তৃণমূলে ফিরবেন, এমন তত্ত্ব উঠে আসছিল কেন? এ বার দৃশ্যতই বিরক্তি প্রকাশ করছেন শোভন। যাবতীয় জল্পনা নস্যাৎ করার ভঙ্গিতে বলছেন, সবই অবান্তর কথা, তৃণমূলে ফেরার প্রশ্নই উঠছে না, সুতরাং রত্নাকে সরানো হল কি না, তা নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। শোভনের কথায়, ‘‘রত্না থাকবেন কি না, সেটা তো তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কোনও কথা বলার অবকাশই নেই। রত্নাকে সামনে রেখে কেউ যদি নোংরামি করতে চায়, করতে পারে। আমার কিছু যায় আসে না।’’

গত বছর ভাইফোঁটায় মমতার বাড়িতে

কিন্তু যাঁর তৃণমূলে থাকা বা না থাকার কোনও গুরুত্বই তাঁর কাছে নেই বলে শোভন দাবি করছেন, সেই রত্না তো সাংঘাতিক আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন। তিনি তো বেহালার বুকে শোভনের জামানত জব্দ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। এটা তো ছোটখাটো চ্যালেঞ্জ নয়। এই প্রশ্ন ওঠায় বিস্ফোরক তথ্য সামনে আনলেন শোভন। বললেন, ‘‘জামানত জব্দ করা তো পরের কথা। রত্না ভোটে লড়তে পারবেন তো?’’ কেন পারবেন না? শোভন বললেন, ‘‘আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী ভোটে লড়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়স হওয়ার পাশাপাশি মানসিক ভাবে সুস্থও হতে হয়। রত্না চট্টোপাধ্যায় মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন, স্থিতিশীল নন। তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই এই কথা বলছি।’’

কী তথ্যপ্রমাণ? এক গোছা প্রেসক্রিপশন এবং ডাক্তারি রিপোর্ট তুলে ধরছেন শোভন। বলছেন, ‘‘ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলে রত্না চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন মনে আছে? এগুলো সেই চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র। রত্না যে মানসিক ভাবে স্থিতিশীল নন, সেই কারণেই যে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন, এগুলো দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। এই রিপোর্টগুলো যদি তুলে ধরি, তা হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য হিসেবে রত্না চট্টোপাধ্যায় বিবেচিত হবেন তো?’’— তীব্র চাহনি নিয়ে প্রশ্নটা ছুড়েই আবার স্বরে গাম্ভীর্য ফেরান কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক। বলেন, ‘‘বড় বড় কথা বলা খুব সহজ। কথার মর্যাদা রক্ষা করা কঠিন।’’

রত্নার প্রসঙ্গে যখন এত কথাই হল, তখন রত্নার আরও এক গুরুতর অভিযোগের কথাও তুলে ধরতেই হয়। শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজে বিজেপিতে যেতে চাননি, তাঁকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, শোভন তৃণমূলে এবং পরিবারে ফিরতে চান, কিন্তু তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে, ‘জেলবন্দির’ মতো জীবন তিনি কাটাচ্ছেন— সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই রকম মন্তব্য করেছেন শোভনের স্ত্রী। ইঙ্গিত যে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রত্না।

এই প্রসঙ্গে কী বলছেন শোভন? বিতৃষ্ণা এবং বিস্ময় মেশানো মুখভঙ্গি নিয়ে বলছেন, ‘‘আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন, আপনার কি মনে হচ্ছে, আমি জেলে আছি?’’ স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকানোর ভঙ্গিতে বলছেন, ‘‘আমি সোজা কথা সোজা ভাবে বলি। আমি বাচ্চা ছেলে নেই, যে আমাকে কেউ জোর করবে বা ভুল বোঝাবে। আমি গত দু’বছর ধরে এখানে শান্তিতে আছি, সাবলীল আছি। রত্না চট্টোপাধ্যায়ের অশালীন কথাবার্তার জবাব দিতে চাই না।’’

ছবি ও ভিডিয়ো: মৃণালকান্তি হালদার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement