Nabanna

Panchayat: জেলা পরিষদের ‘ডানা ছাঁটাই’, গ্রামে খরচের এক্তিয়ার পঞ্চায়েত দফতরের হাতে দিল নবান্ন

সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সামাজিক খাতে বিপুল ব্যয়ের কারণে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বরাদ্দে কিছুটা হলেও টান পড়ছে। এর মধ্যে অর্থ ‘নয়ছয়’ হলে মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সরকারের পক্ষে মুশকিল।

Advertisement

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২২ ০৫:৩৮
Share:

ফাইল চিত্র।

বছর ঘুরলেই পঞ্চায়েত ভোট। ইতিমধ্যেই তার জন্য কোমর বাঁধছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই আবহে গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতে খরচের এক্তিয়ার জেলা পরিষদের হাত থেকে ‘কমিয়ে’ পঞ্চায়েত দফতরের হাতে কেন্দ্রীভূত করার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য।

Advertisement

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, সরকারি কাজের বরাত ঘিরে দুর্নীতি এবং ‘টাকার বখরা নিয়ে’ দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগে সম্প্রতি বার বার বিদ্ধ হয়েছে শাসকদল তৃণমূল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার সেই দুর্নীতিকে রেয়াত না করার কড়া বার্তা দিলেও, জেলায়-জেলায় বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি কিংবা প্রাসাদোপম বাড়ির খবর উঠে এসেছে সংবাদের শিরোনামে। এই পরিস্থিতিতে তাই আগামী বছরের ভোটের আগে জেলা পরিষদগুলির ‘আর্থিক ক্ষমতা ছাঁটাই’ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।

প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, এত দিন গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (আরআইডিএফ) আওতায় পরিকল্পনা ও বিস্তারিত প্রকল্প-রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরি করে তা পঞ্চায়েত দফতরের কাছে পাঠাত জেলা পরিষদগুলি। রাজ্য তা নাবার্ডকে পাঠাত। যে প্রকল্পগুলিতে নাবার্ড অনুমোদন দিত, সেগুলির কাজ শুরু করতে সংশ্লিষ্ট জেলাকে নির্দেশ দিত রাজ্য। সেই প্রকল্পের টেন্ডার ডাকা এবং ওয়ার্ক-অর্ডার দেওয়ার দায়িত্বও বর্তাত জেলা পরিষদের উপরে। সম্প্রতি আরআইডিএফ-এর আওতায় রাজ্যে ১০৩টি নতুন গ্রামীণ রাস্তার জন্য অনুমোদন দিয়েছে নাবার্ড। নয়া নির্দেশ মেনে, ওই বরাত থেকে এই ধরনের সমস্ত প্রকল্পে ডিপিআর জেলা পরিষদ তৈরি করলেও, তা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার দায়িত্বে থাকা সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ারকে। পঞ্চায়েত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা ডিপিআর যাচাই, টেন্ডার ডাকা এবং চূড়ান্ত দরপত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রকল্পের নজরদারি থাকবে পঞ্চায়েত দফতরের অধীনস্থ রাজ্য গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থার (এসআরডিএ) উপরে।

Advertisement

পঞ্চায়েতমন্ত্রী পুলক রায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বরাবর কাজের গুণমানে নজর রাখেন। জেলা পরিষদ পঞ্চায়েতের মধ্যেই। কাজের সুবিধা এবং তাতে গতির জন্য এই সিদ্ধান্ত। কারণ, গ্রামীণ রাস্তাঘাট এবং পরিকাঠামো খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

সম্প্রতি পঞ্চায়েত দফতর সাত জন সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ারকে ২৩টি জেলার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে। ঠিক হয়েছে তাঁরাই গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (আরআইডিএফ) আওতায় কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া দেখভাল করবেন। এর ফলে জেলা পরিষদের হাত থেকে এই ক্ষমতা চলে যাবে সরাসরি পঞ্চায়েত দফতরের অধীনে।

প্রসঙ্গত, আরআইডিএফ-র আওতায় রাস্তা, সেতু-সহ গ্রামীণ পরিকাঠামোর কাজ হয়ে থাকে।

অভিযোগ, সরকারি কাজে অর্থের ‘ভাগ’ নিয়ে অনেক সময়েই জেলায় জেলায় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দায় বর্তায় শাসকদলের উপর। মনে করা হচ্ছে, এই অবস্থায় পঞ্চায়েত ভোটের আগে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত করা গেলে সেই সব সমস্যা ঠেকানোর পাশাপাশি পঞ্চায়েত ভোটে আইনশৃঙ্খলা সমস্যাও অনেকটাই এড়ানো যাবে। ২০১৮-এর পঞ্চায়েতে ভোট-হিংসার কথা মনে করিয়ে অনেকে দাবি করছেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে তেমন ‘অপ্রীতিকর’ পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইবে না শাসকদল।

এক কর্তার কথায়, “টেন্ডার ডাকা থেকে শুরু করে ওয়ার্কঅর্ডার দেওয়া এবং নজরদারি- পুরো কাজটাই কেন্দ্রীয় ভাবে হবে পঞ্চায়েত দফতরের তত্ত্বাবধানে। বিভিন্ন দফতরের চিফ-সুপারিন্টেন্ডিং-এগজিকিউটিভ বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারদের যে আর্থিক ক্ষমতা অর্থ দফতর দিয়েছে, তাতে পঞ্চায়েত দফতরের অধীনে আরআইডিএফ-এর কর্মসূচিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হল।” অপর এক কর্তার অভিমত, “স্থানীয় স্তরে টেন্ডার বা ওয়ার্কঅর্ডার নিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ থেকে যায়। তার নেপথ্যে কাজ করে ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের বিষয়ও। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েই যত কোন্দল। পঞ্চায়েত দফতরের হাতে বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হওয়ায়, সেই প্রবণতায় অনেকটাই রাশ টানা যাবে।”

জেলায় জেলায় তোলাবাজি-কাটমানি বা সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে অনেকদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৯ সালে দিঘায় আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের উদ্বোধন করে মমতা বলেছিলেন, “আমাদের সবাইকে নিজেদের লোভ সংযত করতে হবে...। সরকারি অর্থ আসলে জনগণের অর্থ।” গত ১৮ নভেম্বর হাওড়ায় প্রশাসনিক কর্তাদের সতর্ক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “প্রকল্পের কাজ সরাসরি করবে, যাতে কেউ এখান থেকে টাকা-পয়সা নিতে না পারে। যার প্রয়োজন রয়েছে, একমাত্র সে-ই পাবে।” গত ২৭ মার্চ শিলিগুড়ির একটি সভায় মমতার উক্তি, “আমি দু’মাস সময় নেব। তার পর যদি কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকে....আমাকে জানাবেন।”

প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় স্থানীয় স্তরে সরকারি কাজ থেকে টাকা ‘উপার্জনে’র প্রবণতা ধাক্কা খাচ্ছে। গ্রামীণ স্তরে অর্থের অন্যতম বড় উৎস পঞ্চদশ অর্থ কমিশন এবং আরআইডিএফ। স্থানীয় স্তরে পাড়ায় সমাধান কর্মসূচির ছোট পরিকাঠামো তৈরির কাজে পঞ্চদশ অর্থকমিশনকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি, অর্থ কমিশনের বেশ কিছুটা পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও। ফলে সেগুলির থেকে ‘আমদানি’র রাস্তা ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়েছে। এ বার আরআইডিএফ-ও রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসায় স্থানীয় স্তরে সেই তহবিল নিজ-স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ কমবে।

সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সামাজিক খাতে বিপুল ব্যয়ের কারণে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বরাদ্দে কিছুটা হলেও টান পড়ছে। এর মধ্যে অর্থ ‘নয়ছয়’ হলে মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সরকারের পক্ষে মুশকিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement