হাইকোর্টের রায় এর পর চাকরি চলে যাওয়া হতাশ শিক্ষক-শিক্ষিকারা l — নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা ভোট শেষ হওয়ার পনেরো দিনের মধ্যেই স্কুলে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সোমবার এসএসসি-কে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। কিন্তু সেই নিয়োগের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ কী হবে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা মঙ্গলবারও দিতে পারল না এসএসসি। বরং হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আজ, বুধবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার মঙ্গলবার বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যা ঠিক আছে, তাতে বুধবারই আমরা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করব।’’ শীর্ষ আদালতের দরজায় কড়া নাড়ার কথা জানিয়েছেন নিজেদের যোগ্য বলে দাবি করা সদ্য চাকরিহারাদের প্রতিনিধিরাও।
সিদ্ধার্থ জানান, তাঁরা প্রায় পাঁচ হাজার জনের নিয়োগের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। বাকিদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা স্পষ্ট নয় বলে তাঁর দাবি। সেই কারণেই সব নিয়োগ বাতিলের এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে যাচ্ছেন তাঁরা। সিদ্ধার্থর দাবি, ‘‘আমরা ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেআইনি নিয়োগের তালিকা হাই কোর্টের হাতে তুলে দিয়েছি।’’ সমস্ত চাকরিপ্রাপকের মধ্যে কি তবে ওই পাঁচ হাজার জনের মতোই অযোগ্য? তার বাইরে অযোগ্য কেউ নেই? এই কথা নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের প্রয়োজন পড়ল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সিদ্ধার্থ বলেন, ওই তালিকাই যে একেবারে সম্পূর্ণ, তা বলার মতো জায়গায় তাঁরা নেই!
দুর্নীতি যে ব্যাপক এবং তার শিকড় যে অনেক গভীরে, হাই কোর্টের রায়ের ছত্রে-ছত্রে তা স্পষ্ট। এসএসসি-র ২০১৬ সালের নিয়োগকে ‘মানুষের খাওয়ার অযোগ্য কাঁকর মেশানো চাল’ হিসেবে সোমবারের রায়ে উল্লেখ করেছে বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। সেখানে বলা হয়েছে, জালিয়াতির শিকড় এত গভীরে যে, এই চাল থেকে কাঁকর বেছে ফেলার চেষ্টা পণ্ডশ্রম। এতে মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়বে এবং অসততাকে উৎসাহ দেওয়া হবে।
সোমবার এসএসসি মামলার রায় দিতে গিয়ে ২০১৬-র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াকেই বাতিল করে দিয়েছে বেঞ্চ। কেন অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি বাতিল করে যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি বহাল রাখা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। আইনজীবীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, কী পরিস্থিতিতে পুরো নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা ওই ‘কাঁকর মেশানো চাল’ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছে আদালত।
রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, ফাঁকা উত্তরপত্র (ওএমআর) জমা দিয়েও বহু পরীক্ষার্থী অনেক বেশি নম্বর পেয়েছেন। যদিও ঠিক কত জন বেআইনি ভাবে চাকরি পেয়েছেন তা এসএসসি-র অসহযোগিতার জন্যই চিহ্নিত করা যায়নি। তার পরেও যা তথ্য এসেছে, তাতে শুধু গ্রুপ-ডি পদেই ৪৮ শতাংশ ব্যক্তি অবৈধ ভাবে নিযুক্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই ২০১৬ সালের সব নিয়োগ বাতিল করে নতুন ভাবে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছে কোর্ট। ওএমআর শিট তৈরি, মূল্যায়ন এবং স্ক্যান করার জন্য খোলা দরপত্র ডেকে নতুন সংস্থাকে নিয়োগও করতে বলেছে আদালত।
আইনজীবীদের একাংশের দাবি, পুরনো উত্তরপত্র বাতিল করে নতুন উত্তরপত্র তৈরি করতে বলার অর্থ ফের পরীক্ষায় বসতে হবে পরীক্ষার্থীদের। তবে কোর্ট আদতে তা-ই বলেছে কি না, তা নিয়ে ধন্দ কাটেনি। হাই কোর্ট নতুন নিয়োগের নির্দেশ দিলেও চাকরিপ্রার্থীদের অনেকের প্রশ্ন, গত আট বছরে যাঁদের চাকরির বয়স পেরিয়ে গিয়েছে, তাঁরা কি সুবিধা পাবেন? নিয়োগে সত্যিই যাঁরা যোগ্য প্রার্থী হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা কেন ফের পরীক্ষায় বসবেন? এ বার পরীক্ষায় যে তাঁরা পাশ করবেন, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তা হলে তাঁরা অনুত্তীর্ণ হলে ভবিষ্যৎ কী হবে? আইনজীবীদের অনেকের ব্যাখ্যা, এ ক্ষেত্রে আদালত নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে আইন খতিয়ে দেখে বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়ার অধিকার এসএসসির আছে। এ ক্ষেত্রে তারা যথাযথ পদক্ষেপ করতে পারে।
এসএসসি প্রায় ২৪ হাজার সুপারিশপত্র দিলেও মোট ২৫৭৫৩ জনের নিয়োগ হল কী ভাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের একাংশের দাবি, এর অর্থ, সুপারিশপত্র ছাড়াই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ নিয়োগপত্র দিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি স্কুলের শিক্ষক অনিমেষ হালদার বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে ২০১৬-তে এক জনের নিয়োগ হলেও তিনি এসএসসির সুপারিশপত্র দেখাতে পারেননি। সরাসরি পর্ষদের নিয়োগপত্র দেখিয়েছিলেন।’’ প্রসঙ্গত, পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় ওই নিয়োগপত্র দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তিনি এখন জেলে।
এই প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র হাতে শহিদ মিনার চত্বরে মঙ্গলবার বিক্ষোভ দেখালেন সদ্য চাকরিহারা শিক্ষকেরা। তাঁদের দাবি, যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও কেন চাকরি বাতিল হল, সেই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা? তাঁরা জানিয়েছেন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে গেলেও তাঁদের উপরে পুরোপুরি ভরসা না রেখে তাঁদেরও এক প্রতিনিধি দল আজ, বুধবার সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন।
আন্দোলনরত স্বর্ণালি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা যে যোগ্যতা অনুযায়ী পাশ করে চাকরি পেয়েছি, তার প্রমাণ হিসেবে আমাদের কাছে ওএমআর শিটের স্ক্যান কপি রয়েছে। বাতিলের দলে পড়ে সামাজিক ভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে। আমাদের অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত।’’ শহিদ মিনার থেকে তাঁরা এ দিন বিকেলে পর্ষদের অফিসে যান। সঙ্গে ছিল তৃণমূল প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি। তার রাজ্য সভাপতি মইদুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই শিক্ষকদের পাশেথাকতে এসেছি।’’
পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধির বৈঠক হয়। বৈঠকের পরে এমনই এক চাকরিহারা শিক্ষক মেহেবুব মণ্ডল বলেন, ‘‘সভাপতি জানিয়েছেন, হাই কোর্টের রায়ের সঙ্গে তাঁরা একমত নন। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন। আমাদেরও প্রতিনিধি দল বুধবার সুপ্রিম কোর্টে যাবে। দেখা করব শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গেও।’’ পরে রামানুজ বলেন, ‘‘একজন নির্দোষের সঙ্গেও যেন অন্যায় না হয়, তা দেখছি। সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
এসএসসি রায় প্রসঙ্গে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর মতো উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির দফতরে এ রকম ঘটতে পারে দেখে আমি বিস্মিত।... কোর্টের রায় প্রমাণ করেছে, যা শুনেছিলাম তা সত্যি। এ রকম ঘটনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নষ্ট করে।’’