‘সোনার ছেলে’কে ঘরে বরণ মা পূর্ণিমা শিউলির। ছবি: সুব্রত জানা
এখনও ভাবি, সে দিন যদি ওই ঘুড়িটা ধরার জন্য না ছুটতাম, তা হলে কি আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারতাম?
বাচ্চা বয়স থেকেই আমার ঘুড়ি ওড়ানো আর ঘুড়ি ধরার শখ। বছরটা ২০১১। একটা কাটা ঘুড়ি ধরতে গিয়ে আমাদের দেউলপুরের স্থানীয় ব্যায়ামাগারে ঢুকে পড়ি। ওখানেই দেখি দাদা (অলক শিউলি) এবং আরও কয়েক জন বড় বড় ওজন তুলছে। বছর দশেক বয়স তখন আমার। ভাল করে বুঝতামও না, ভারোত্তোলন ব্যাপারটা কী। কিন্তু দাদাকে দেখে খুব ভাল লেগে গেল। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলি, আমিও ভারোত্তোলক হব।
বছর এগারো পরে, বার্মিংহামের পদক-মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন জাতীয় পতাকা উড়তে দেখলাম, চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, দেখো, আমিও পেরেছি। স্বাধীনতা দিবসের কিছু দিন আগে, কমনওয়েলথ গেমসের এই সোনার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম। মনে হচ্ছিল, এই সোনার ছটায় অনেক অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।
সে দিন পোডিয়ামে সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে যখন দাঁড়িয়েছিলাম, মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল অনেকের মুখ। আমার মায়ের, আমার দাদার। আমার জন্য অনেক আত্মত্যাগ করেছে। দাদা তো ভারোত্তোলনই ছেড়ে দিয়েছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল, আমার কোচ অষ্টম দাসের কথা। যাঁর হাত ধরে আমার ভারোত্তোলনে প্রবেশ। আর মনে পড়ে যাচ্ছিল, সে সব দিনের কথা, যখন চরম দারিদ্র সহ্য করে লড়াইটা চালাতে হয়েছিল। কিন্তু সেই দারিদ্রের শৃঙ্খলও আমাকে পরাধীন করে রাখতে পারেনি। যা হয়তো ইংল্যান্ডের মাটিতেই বুঝিয়ে দিতে পেরেছি।
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অষ্টম স্যরের কাছেই স্থানীয় ব্যায়ামাগারে প্রশিক্ষণ নিই। আমার আগ্রহ দেখে স্যর দাদাকে বলেছিলেন, ঠিক আছে। ওকে নিয়ে এস। দেখা যাক কী করা যায়। স্যর প্রথমে আমাকে নানা ব্যায়ামের মাধ্যমে তৈরি করেন। ভারোত্তোলনের টেকনিক বোঝান। তার পরে আমার আসল ট্রেনিং শুরু হয়। গুরুর দেখানো রাস্তায় আমার পথ চলা শুরু। আমার পরিবার, আমার কোচেরা পাশে না থাকলে কি আর এখানে পৌঁছতে পারতাম!
সবাই জানে, ভারোত্তোলন এমন একটা খেলা যেখানে শরীরের প্রচুর যত্ন করতে হয়। দরকার হয় পুষ্টিকর খাদ্যের। কিন্তু আমাদের গরিবের সংসারে সে সব কোথায়। তার পরে হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ হয়। অন্নসংস্থানের জন্য ভারোত্তোলন ছেড়ে দাদাকে কাজে ঢুকতে হয়। আমি, মা, দাদা মিলে শাড়িতে জরি বসানোর কাজ করতাম। দাদা তখন নিজে ভারোত্তোলন ছেড়ে আমাকে তৈরি করার কাজে ডুবে গেল।
আমার কাছে এখন অনেকেই জানতে চান, ওই সময় কী খেতাম। তখন আমাদের ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে কাটাতে হত। কখনও শুধু ভাত-ডাল। এমন দিনও গিয়েছে, যখন শুধু শুকনো ভাত খেয়ে থাকতে হয়েছে। আর কিছুই পাইনি খেতে। আমাকে ঘিরে থাকা কয়েক জনের বাইরে ওই সময় কাউকেই পাশে পাইনি। নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়েছি। কিন্তু কখনও লড়াই ছেড়ে সরে আসার কথা ভাবিনি।
এই ভাবে অষ্টম স্যরের হাতে তৈরি হতে হতে ২০১৫ সালে সুযোগ এসে গেল। স্যরই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পুণেতে। যেখানে সেনাবাহিনীর ট্রায়াল ছিল। সে বছর থেকেই আমি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। আর আমার ভারোত্তোলন জীবন পূর্ণতা পায়। পুষ্টিকর খাদ্য থেকে শুরু করে যা যা দরকার, সব পেতে শুরু করি।
এর পরে ২০১৮ সাল থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করি। প্রথমে জাতীয় স্তরে, তার পরে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পদক আসতে শুরু করে। কমনওয়েলথ গেমসের সোনার পদক আমার এই যাত্রাপথেরই একটা মোড়। আমাকে এখনও অনেক দূর যেতে হবে। অনেক শৃঙ্গ জয় করতে হবে।
পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের আগে আমার একটাই অঙ্গীকার। জীবনে কখনও লড়াই ছেড়ে সরে আসব না।
অনুলিখন: কৌশিক দাশ