মুকুলের ভবিষ্যৎ কী? — ফাইল চিত্র।
মুকুল রায় কি মানসিক ভাবে সুস্থ নন? কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়কের দিল্লিযাত্রার পর থেকেই এ নিয়ে জল্পনা চলছে। প্রথম দিনেই মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু রায় দাবি করেন, তাঁর বাবা মানসিক ভাবে সুস্থ নন। সোমবার মুকুল দাবি করেছেন, তাঁকে তাঁর পরিবারই মানসিক ভারসাম্যহীন বানাতে চায়। নিয়ম অনুযায়ী, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ ব্যক্তি বিধায়ক থাকতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে কী হবে মুকুলের?
স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তৃণমূল এবং বিজেপিও সেই ব্যবস্থা নেওয়ারই পক্ষে। তবে মুকুল আদৌ ততটা ‘অসুস্থ’ নন বলেই মনে করছেন সিপিএমের আইনজীবী সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
দিল্লিতে বসে মুকুল দাবি করেছেন, বাড়ির লোক তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। শুক্রবারই তিনি বলেছেন, ‘‘আমার শরীর এখন ঠিক আছে। আমি পূর্ণ সুস্থ। মাঝে শরীর খারাপ হয়েছিল। এখন ঠিক আছে। বাড়ির লোক অসুস্থ অসুস্থ করে পাগল প্রমাণের জন্য মনের উপর একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। তাই বাড়ির কাউকে না জানিয়েই দিল্লিতে চলে এসেছি।”
ছেলে শুভ্রাংশুর নাম মুকুল নেননি। তবে এটা ঠিক যে, মুকুলের দিল্লিযাত্রার পর থেকেই অধুনা তৃণমূল নেতা শুভ্রাংশু বলে চলেছেন তাঁর বাবা মানসিক ভাবে সুস্থ নন। প্রথমে ‘নিখোঁজ’ এবং পরে ‘অপহরণ’-এর অভিযোগও দায়ের করেছেন পুলিশে। সেই সময়েই বলেছিলেন, ‘‘মুকুল রায় মানসিক ভাবে সুস্থ নন। এখানে টাকার খেলা হয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, তাঁর কাছে মুকুলের মেডিক্যাল রিপোর্ট রয়েছে। শুভ্রাংশু বলেছেন, ‘‘উনি হাঁটতে পারছেন না ভাল করে। অস্ত্রোপচারের আগে পর্যন্ত তাঁকে ডায়াপার পরিয়ে রাখতে হত।’’
মানসিক ভাবে ‘সুস্থ’ নন, এমন কেউ বিধায়ক থাকতে পারেন কি না এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। সেই প্রশ্নের জবাবে রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ করলে মুকুল মানসিক ভাবে সুস্থ কি না, তা জানতে উদ্যোগী হবেন তিনি। বিমান শনিবার বলেন, ‘‘যদি মস্তিষ্কবিকৃতির অভিযোগ আসে, তবে আমাকে সেটা মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে পাঠাতে হবে। সেই বোর্ড যে রিপোর্ট দেবে, তাতে আমি যদি সন্তুষ্ট হই, তবে বিধায়ক পদ খারিজের জন্য যা যা পদক্ষেপের নিয়ম রয়েছে তা আমি করব।’’ একই সঙ্গে স্পিকার জানান, তাঁর কাছে নিয়ম মেনে অভিযোগ জমা পড়লে তবেই তিনি কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাববেন। পাশাপাশিই বিমান বলেন, ‘‘আমার কাছে কোনও নিয়মমাফিক অভিযোগ না এলে মাথাখারাপ নিয়ে কোথায় কী বলা হচ্ছে, তা দেখে আমি কিছুই করব না।’’
তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক সাংসদ শান্তনু সেন মনে করছেন, মুকুলের যে মানসিক অবস্থা, তাতে তিনি বিধায়ক থাকতে পারেন না। শনিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘সহজ ভাষায় আমরা মস্তিষ্কবিকৃতিকে পাগল বলি। আমি কিন্তু সেটা বলতে চাইছি না। তাঁর শারীরিক সমস্যার কথা বলছি। তাঁর ডিমেনশিয়া হয়েছে। মানে তিনি সব ভুলে যান। তাঁর পার্কিনসন্স হয়েছে। মানে তাঁর হাত-পা কাঁপে। এটা চিকিৎসকেরাই বলেছেন। কারও ডিমেনশিয়া রয়েছে মানে তো মানসিক অসুস্থতা প্রমাণিত!’’ এ ক্ষেত্রে মুকুলের সাম্প্রতিক অসুস্থতার পরে হাসপাতালের ডিসচার্জ রিপোর্টের কথাও উল্লেখ করেন শান্তনু। তিনি বলেন, ‘‘প্রমাণিত মানসিক অসুস্থ একজন ব্যক্তির কথার কী গুরুত্ব থাকে? নিয়মেই রয়েছে যে, কেউ যদি মানসিক ভাবে অসুস্থ হন এবং আদালতের রায় থাকে, তা হলে তিনি যাঁদের জনপ্রতিনিধি, তাঁদের জন্য কাজ করতে পারছেন না ধরে নিয়ে তাঁর পদ চলে যায়। এটা সম্পূর্ণই স্পিকারের হাতে। সেটা নিয়ে আমি বলতে পারি না। তবে একজন চিকিৎসক হিসাবে বলতেই পারি যে, তিনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে অসুস্থ।’’
প্রায় একই রকম কথা বিজেপির আইনজীবী নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারির। তিনি বলেন, ‘‘এর জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে। সেটা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে স্পিকারের হাতেই সব ক্ষমতা। আমাদের প্রার্থী হয়ে জিতলেও উনি এখন তৃণমূলে। কিন্তু ওঁর অসুস্থতার জন্য কৃষ্ণনগর উত্তরের মানুষ উন্নয়নমূলক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। শরীর খারাপ হয়ে থাকলে তো ওঁর নিজের থেকেই সরে যাওয়া উচিত।’’ তরুণজ্যোতি বলেন, ‘‘ডিমেনশিয়ার সমস্যা থাকলে স্থায়ী সমাধান হয় না। আর ওঁর কথাবার্তা শুনে তো সুস্থ মনে হয় না। ২০২৩ সালে এসে বলছেন বামফ্রন্টকে সরাতে হবে।’’
তবে যে যাই বলুক, মুকুল ‘অসুস্থ’ বলে আদৌ মনে করছেন না বিকাশরঞ্জন। তিনি বলেন, ‘‘বালখিল্য কথাবার্তা হচ্ছে। কেউ কাউকে পাগল বললেই কি কেউ পাগল প্রমাণিত হয়ে যায়? মুকুলবাবু যথেষ্টই স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলছেন, চলাফেরা করছেন। মানসিক অসুস্থতার যে সংজ্ঞা রয়েছে, তার সঙ্গে এগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই।’’ এই সম্পর্কে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘‘কেউ যদি স্বাধীন ভাবে কোনও চিন্তাভাবনা করতে না পারেন, মানে তাঁর স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা নেই, তবে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। সেটা তাঁর পুত্র বললেই তো হবে না! মুকুলবাবুর যে কর্মকাণ্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে তিনি সক্ষম ভাবেই সব কাজ করছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর মানসিক বৈকল্যের কোনও রকম লক্ষণ নেই।’’ বিকাশের দাবি, আসলে মুকুল যা যা বলছেন বা বলবেন, সেটা যাতে গ্রাহ্য না হয়, তার জন্যই এই চেষ্টা। পাশাপাশিই তিনি বলেন, ‘‘আইন বলছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্মত ভাবে যদি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন বলা হয়, তবেই তা গ্রাহ্য। যদি দেখা যায় তিনি যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তখন তাঁর কাজকর্ম বা কোনও দলিলে সই করলে তবে তা আইনের চোখে গ্রাহ্য হবে না।’’
তবে মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণে বিধায়ক পদ চলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দীর্ঘ আইনি পদ্ধতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী বিকাশ। তিনি বলেন, ‘‘মানসিক ভারসাম্য না থাকলে তিনি বিধায়ক পদে থাকতে পারেন না। প্রথমে চিকিৎকরা তাঁদের নিদান দেবেন। সেই নিদান যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করেন, তবে তা কোর্টে বিচার হবে। চিকিৎসকদের নিদান সঠিক কি না জানতে কোর্ট বিশেষজ্ঞের মতামত নেবে। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে সেটা প্রমাণ করা যায় না। সেখানে বলা রয়েছে— অসুস্থ। তার মানেই তো মানসিক ভারসাম্যহীনতা নয়!’’
মুকুল বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাঁর বিধায়ক পদ খারিজের দাবিতে সরব বিজেপি। তৃণমূলও এখন মুকুলের জনপ্রতিনিধি থাকার বিরোধিতা করে স্পিকারের কাছে যাবে কি না, তা ঠিক হয়নি। শান্তনু বলেন, ‘‘কেউ ব্যক্তিগত ভাবে আবেদন করবেন কি না, তা তো আমি বলতে পারি না। কেউ করলে স্পিকার নিয়ম মেনেই সিদ্ধান্ত নেবেন। আর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সঠিক সময়ে নিশ্চয়ই বিবেচনা করবেন।’’ একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘মুকুল রায়ের ক্ষেত্রে কোন দলের কথা বলা হচ্ছে, সেটাও তো একটা বড় প্রশ্ন।’’ প্রসঙ্গত, মুকুল তৃণমূলে যোগ দিলেও সাম্প্রতিক বিতর্কের পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘উনি বিজেপির বিধায়ক।’’