মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন পর্ব থেকে যে ‘হিংসা’র সূত্রপাত হয়েছিল, ভোটগণনা পর্বেও তাতে লাগাম পরানো যায়নি। বিরোধী দলগুলি যখন এই অভিযোগ তুলে তৃণমূলের সমালোচনায় মুখর, তখন ‘রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে’ বলে সরব হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া গণনা এখনও সম্পূর্ণ না হলেও রাজ্যের ২০টি জেলা পরিষদেই তৃণমূল তাদের দাপট ধরে রাখছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বুধবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের জয়ের জন্য ‘মা-মাটি-মানুষ’কে ধন্যবাদ জানালেন। ‘সমালোচনা’র মাধ্যমে ‘আত্মনির্ভরতা’ দেওয়ার জন্য আলাদা করে ‘ধন্যবাদ’ জানালেন সংবাদমাধ্যমের একাংশকেও। নির্বাচনে গোলমাল পাকানোর জন্য বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপিকে নিয়ে তৈরি হওয়া ‘মহাঘোঁট’কে নিশানা করেন তিনি।
তবে ভোট পাটিগণিতে যখন কিছুটা হলেও বাম এবং কংগ্রেসের জমি ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত মিলছে, সেই সময় এই দু’টি দলকে নিয়ে খুব বেশি ‘শব্দ ব্যয়’ করেননি মমতা। বরং কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপিকে একাধিক বিষয়ে কটাক্ষ করেছেন। তিন বিরোধী দলকে এক বন্ধনীতে রেখে ‘মহাঘোঁট’ বলে আক্রমণ শানালেও বাম-কংগ্রেসের প্রতি ‘নরম’ হওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ভোট ঘিরে অশান্তির জন্য কিছু ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে যেমন তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনই কেন্দ্রীয় বাহিনীর কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত ভোটের আগেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’মাসব্যাপী তৃণমূলের ‘নবজোয়ার যাত্রা’য় অংশ নিয়েছিলেন। শুক্রবার একাধিক বার দলের এই কর্মসূচির প্রশংসা শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর গলায়। অনেকেই মনে করছেন, ‘নবজোয়ারে’র প্রশংসার মাধ্যমে পঞ্চায়েত ভোটে দলের বিপুল সাফল্যের কৃতিত্ব অভিষেককেও দিতে চেয়েছেন মমতা।
দুই জেলা, যত ঝামেলা
পঞ্চায়েত ভোটকে ঘিরে হিংসার ঘটনা মোটের উপর দুই জেলাতেই হয়েছে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ওই জেলা দু’টি হল মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আসল ঘটনা ঘটেছে দুটো জেলায়।” তার পরেই সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তার জন্য আপনারা ২৩টি জেলার ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। হিংসা হিংসা করে আপনারা সারা ভারতবর্ষে আমাদের বদনাম করলেন।” বাংলার অপমান করলে তাঁর গায়ে লাগে, এ কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমায় দুটো চড় মারুন। কিন্তু বাংলা মাকে অসম্মান করবেন না।” রাজ্যে ২৫-৩০ বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গাতেই ঝামেলা হয়, সে কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, “ভাল করে খেয়াল করে দেখবেন, ওই স্পটগুলোতেই গন্ডগোল হয়।” রাজনৈতিক হিংসা এবং হানাহানির জন্য, যে এলাকাগুলি সংবাদ শিরোনামে এসেছে, সেগ়ুলির মধ্যে দু’টির উল্লেখ করে মমতা বলেন, “ডোমকলে বিরোধীরা জিতেছে। ভাঙড়ে জিতেছে কে? বিরোধী দল।” হিংসার জন্য মুখ্যমন্ত্রী প্রকারান্তরে বিরোধীদেরই দুষতে চেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে মুর্শিদাবাদের অশান্তির জন্য নাম না করেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীকে নিশানা করেছেন তিনি। মমতার কথায়, “মুর্শিদাবাদের ঘটনা কে ঘটিয়েছেন আপনারা জানেন? তিনি নিজেকে দেশের নেতা বলেন।”
কমিশনের ভূমিকায় প্রশ্ন
বুথসংখ্যা এবং অন্যান্য ব্যাপকতার নিরিখে হিংসা কিংবা অশান্তির ঘটনা যে নগণ্য, সে কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কয়েকটি বিষয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ব্যালট বাক্সে জল ঢেলে ভোট ভন্ডুল করার একাধিক ছবি ধরা পড়েছিল শনিবার। সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করে মমতা বলেন, “জলের বোতল নিয়ে গিয়ে জল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। কেন গ্রেফতার করবেন না? এই রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে।” রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের একাংশকে নিশানা করে তিনি বলেন, “কো-অর্ডিনেশন কমিটির কেউ কেউ ব্যালটে সই করেননি। এ জন্য আমাদের অনেক ভোট বাতিল হয়েছে।” মঙ্গলবার রাতে ভাঙড়ের সংঘর্ষের ঘটনাও এড়ানো যেত বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এর পাশাপাশি কমিশনের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, “৭১ হাজার বুথে ভোট হয়েছে। ঝামেলা হয়েছে মাত্র সাত-আটটি বুথে।” এই প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “কোথাও ভোটের পর ৭০০ বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে এমনটা দেখান।”
মৃতদের ক্ষতিপূরণ, চাকরির ঘোষণা
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা থেকে এখনও পর্যন্ত ১৯ জন মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১০ জনই তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক বলে জানিয়েছেন তিনি। মমতা জানিয়েছেন, মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য সরকার। দেওয়া হবে হোমগার্ডের চাকরিও। এ ক্ষেত্রে যে কোনও দলীয় বিভাজন করা হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। মৃতদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশকে পদক্ষেপ করতে বলেছি।”
নিশানায় সেই বিজেপিই
বিজেপি শাসনাধীন মণিপুর, অসম এবং উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ওই সব রাজ্যে ক’টা কমিশন গিয়েছে?” প্রসঙ্গত, বুধবারই ভোট-হিংসার কারণ জানতে রাজ্যে এসেছে বিজেপির তথ্যানুসন্ধানী কমিটি। সেই কমিটির ‘বিজেপির প্রোটেকশন কমিটি’ বলে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, “১৫৪টি কমিশন পাঠিয়েছে এ রাজ্যে। মণিপুরে ক’টা গিয়েছে?” তার পরেই বিরোধীদের উদ্দেশে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে মমতা বলেন, “মানুষের রায় মাথা পেতে মেনে নিন। মানুষকে ধন্যবাদ জানান।”
সিপিএম-কংগ্রেসে ‘নরম’
বাম, কংগ্রেস, বিজেপি এবং আইএসএফ-এর ‘আঁতাঁত’কে ‘মহাঘোঁট’ বলে আক্রমণ করলেও এ রাজ্যের সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতৃত্বকে নিয়ে কিছু বলতে চাননি মমতা। তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এ রাজ্যের কংগ্রেস, সিপিএমের জন্য আমার করুণা হয়। দিল্লিতে একটা জোটের কথা চলছে। তাই আমি তাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না।” তার পরেই বাম-কংগ্রেস নেতৃত্বকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “এখানে তোমরা আমায় গালাগাল দেবে, আর আমি তোমাদের নৈবেদ্য ধরে দেব?” তবে রাজ্যে যাতে হিংসার আর কোনও ঘটনাই না ঘটে, তার জন্য ভবিষ্যতেও তিনি কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত ভোটে দলের সাফল্যের ‘উদ্যাপন’ না করে ২১ জুলাই, তৃণমূলের শহিদ দিবসের দিনটিকে ‘শ্রদ্ধা দিবস’ হিসাবে পালন করার কথা জানিয়েছেন মমতা। ওই দিন অন্যান্য বছরের মতোই ধর্মতলায় সভা করবে তৃণমূল। সভায় নিহত তৃণমূল কর্মীদের শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে জানিয়েছেন মমতা।