TMC BJP

পদ্ম থেকে ঘাসফুলে যোগ, এক এক জনের জন্য এক এক রকমের নিয়ম, কার হাতে কী এবং কেন, জেনে নিন

কারও হাতে শুধুই উত্তরীয়। কাউকে উত্তরীয়ের সঙ্গে জোড়াফুল আঁকা পতাকাও ধরানো হয় হাতে। কেন এই বিভিন্নতা? এর পিছনে কি কোনও কৌশল রয়েছে? কৌশল থাকলে তার কারণ কী?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৫৯
Share:

(উপরে) বাবুল সুপ্রিয়ের তৃণমূলে যোগদান। কৃষ্ণ কল্যাণীর তৃণমূলে যোগদান (নীচে)। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

আড়াই বছর আগে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফেরা বা ‘উন্নয়নের টানে’ ঘাসফুল শিবিরে সামিল হওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত। মুকুল রায়কে দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, তাতে শেষতম সংযোজন বাঁকুড়ার কোতুলপুরের বিজেপি বিধায়ক হরকালী প্রতিহার। মাঝে আরও বিধায়ক, বাবুল সুপ্রিয়, অর্জুন সিংহের মতো সাংসদেরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন বা ফিরেছেন। কিন্তু সকলের ‘পাসপোর্ট’ এক নয়। দৃশ্যতই ফারাক রয়েছে।

Advertisement

যোগদানের ঔপচারিকতায় কার ক্ষেত্রে কী ছিল?

২০২১ সালের ২ মে বেলা গড়াতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বাংলার সরকারে তৃতীয় বারের জন্য তৃণমূল শুধু ফিরছেই না, ‘আগ্রাসী’ বিজেপিকে কার্যত মাটি ধরিয়ে প্রত্যাবর্তন ঘটছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিজেপির যাঁরা জিতেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণনগর উত্তর আসনের মুকুল রায়। মুকুলপুত্র শুভ্রাংশু অবশ্য বীজপুরে হেরে গিয়েছিলেন বিজেপির টিকিটে। কিন্তু ছেলেকে নিয়েই ১১ জুন মুকুল ফিরেছিলেন তৃণমূলে। দলের রাজ্য দফতর তৃণমূল ভবনে সেই কর্মসূচিতে হাজির ছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু একদা তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’-এর গলায় ‘ঘর ওয়াপসি’র উত্তরীয় পরিয়ে দিয়েছিলেন ততদিনে দলের ‘সেনাপতি’ হয়ে ওঠা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুকুলপুত্রের গলাতেও স্বাগত উত্তরীয় পরিয়ে দিয়েছিলেন অভিষেকই। সাদা খোলের হলেও পাড়ের কাছে রঙিন কারুকাজ ছিল সেই উত্তরীয়তে। আর লেখা ছিল ‘মা-মাটি-মানুষ।’ কিন্তু ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হল, মুকুল বা শুভ্রাংশুর হাতে সেদিন জোড়াফুলের পতাকা দেওয়া হয়নি।

Advertisement

এর পরের দু’টি যোগদান-পর্ব আবার কিছুটা ভিন্ন। উপকরণও আলাদা। ২০২১ সালের ৩০ অগস্ট তৃণমূলে যোগ দেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়ক তন্ময় ঘোষ। তপসিয়ার তৃণমূল ভবনে তন্ময়ের গলায় উত্তরীয় পরানোর পাশাপাশি হাতেও দলের ঝান্ডা ধরিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তন্ময় তৃণমূলে যোগ দেওয়ার এক দিন পরেই ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৃণমূলে ফেরেন বাগদা বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে জেতা বিশ্বজিৎ দাস। তৃণমূল ভবনে বিশ্বজিতের গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরও হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলেন দলের তৎকালীন মহাসচিব তথা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ এখন জেলে। কিন্তু বিজেপির টিকিটে জেতা বিশ্বজিৎ এখন যেমন বিধায়ক, তেমনই তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতিও।

বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তন্ময় ঘোষের হাতে পতাকা ধরাচ্ছেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। —ফাইল চিত্র।

বিজেপি থেকে তৃণমূলে এর পরের যোগদান আচমকা এবং ‘বড়মাপের’। ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে তৃণমূলে যোগদান করেন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তখন সদ্য নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন বাবুল। বিধানসভা ভোটে টালিগঞ্জে হেরেছেন অরূপ বিশ্বাসের কাছে। বাবুলের হাতে তৃণমূলের পতাকা দেওয়া হয়নি। কিন্তু গায়ক থেকে নেতা হওয়া বাবুলের গলায় অভিষেক যে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়েছিলেন, তা আবার অন্যদের মতো ছিল না। সেই উত্তরীয়টি ছিল তেরঙা। তাতে লেখা ছিল ‘মা-মাটি-মানুষ’। আঁকা ছিল দলের প্রতীক জোড়াফুল। অভিষেকের সঙ্গেই সেখানে ছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। বাবুল তার কয়েক দিনের মধ্যেই সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। এখন তিনি তৃণমূলের বিধায়ক হয়ে রাজ্যের মন্ত্রী। তাঁর ছেড়ে আসা আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রথমবার ঘাসফুল ফুটেছে।

এর পর বিজেপির আরও এক বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেন ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর। তিনি রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী। ক়ৃষ্ণ আগে ছিলেন তৃণমূলে। ভোটের তিন মাস আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার পরে ভোটে জিতে পাঁচ মাসের মধ্যেই ফিরে আসেন পুরনো দলে। কৃষ্ণকে হাতে পতাকা দেওয়া হয়েছিল। দিয়েছিলেন পার্থ। সেই যোগদানপর্ব হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হোটেলে।

২০২২ সালের মে মাসে আরও এক বিজেপি সাংসদ তৃণমূলে সামিল হন। যিনি টিকিট না পেয়ে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়েছিলেন। তিনি ব্যারাকপুরের ‘দবং’ নেতা অর্জুন সিংহ। তাঁর যোগদানও হয়েছিল অভিষেকের অফিসে। তাঁর হাতেও বাবুলের মতো পতাকা দেওয়া হয়নি। তাঁকে দেওয়া হয়েছিল দলের প্রতীক আঁকা তেরঙা উত্তরীয়। পাশে ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার অন্যতম নেতা তথা মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক।

হরকালী প্রতিহারকে উত্তরীয় পরাচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ছবি তৃণমূলের এক্স হ্যান্ডেল থেকে নেওয়া।

২০২৩ সালের শুরুতে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল এবং পুজো মেটার পর কোতুলপুরের বিজেপি বিধায়ক হরকালী তৃণমূলে যোগ দেন। এই দু’টি যোগদানই হয়েছিল দলীয় পদে অভিষেকের অভিষেকের পর। দু’জনের ক্ষেত্রেই পতাকা দেওয়া হয়নি। তাঁদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় উত্তরীয়। সেই উত্তরীয় সাদা খোলের হলেও তাতে ‘মা-মাটি-মানুষ’ লেখার পাশাপাশি আঁকা ছিল জোড়াফুলও।

কিন্তু কেন কারও হাতে দলের পতাকা দেওয়া হয় আবার কারও হাতে দেওয়া হয় না?

তৃণমূলের কোনও নেতা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি নন। তবে ঘরোয়া আলোচনায় এক প্রথম সারির নেতা জানাচ্ছেন, দলত্যাগবিরোধী আইন থেকে বাঁচতেই এটা করা হয়। কিন্তু বিশ্বজিৎ দাস, সুমন কাঞ্জিলালের মতো অনেকের হাতে আবার দলের পতাকা দেওয়া হয়েছে। ওই নেতার বক্তব্য, ‘‘যে বিধায়কেরা তৃণমূলে এসে অকুতোভয় হয়ে বলেন, হাতে পতাকা নেবেন। তাতে যা হয় দেখা যাবে, তাঁদের হাতেই সরাসরি দলের পতাকা দেওয়া হয়।’’ শাসকদলের নেতাদের একাংশের এ-ও বক্তব্য যে, মুকুলের দলত্যাগের বিষয় নিয়ে শুভেন্দু অধিকারী যে ভাবে মামলার পথে হেঁটেছিলেন, তার পর থেকেই মূলত ওই ‘সতর্কতা’ রক্ষা করা হয়। যাতে সরাসরি ‘দলত্যাগ’ করার কোনও প্রমাণ না থাকে। যেমন মুকুলের ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। তাই তাঁর হাতে তৃণমূলের পতাকা দেওয়া হয়নি। সেই কারণেই শুভেন্দুর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৃণমূল পাল্টা যুক্তি দিতে পারছে। মুকুল অবশ্য সম্প্রতি নিজেও বলেছেন, তিনি বিজেপিতেই আছেন!

রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যও বলছেন, ‘‘দলত্যাগবিরোধী আইন থেকে বাঁচতেই তৃণমূল এ সব কৌশল নিচ্ছে। আসলে দলটা টিকে রয়েছে টাকা আর দখলদারি দিয়ে। সময় এলে দেখা যাবে, ওদের পতাকা ধরার কেউ থাকবে না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement