গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
কাহিনি ১: ২০ জুলাই। শিলিগুড়ির এক তরুণী দাবি করেছিলেন, তিনি টোটোতে অপহরণের শিকার হতে হতে বেঁচেছেন! সমাজমাধ্যমের পোস্টে তরুণীর দাবি, তিনি দুপুরবেলা বিনয় মোড় থেকে একটি টোটোয় উঠেছিলেন। যাচ্ছিলেন এনটিএস মোড়ের দিকে। সেই সময় মাঝ রাস্তা থেকে মুখঢাকা এক যুবক টোটোয় ওঠেন। টোটোয় ওঠার পর থেকেই মাঝবয়সি ওই ব্যক্তির হাবেভাবে, চালচলনে তাঁর সন্দেহ হয়। এর পর এনটিএস মোড়ের একটু আগেই টোটো থামাতে বলেন ওই যুবক। তরুণীর দাবি, টোটোচালক টোটো দাঁড় করিয়ে দিতেই তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে এ বার অপহরণ করা হবে। ওই মুহূর্তে তিনি টোটো থেকে নেমে ছুটে গিয়ে রাস্তার পাশে একটি মিষ্টির দোকানে লুকিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচেন!
কাহিনি ২: ২২ জুলাই। শিলিগুড়ির দেশবন্ধু পাড়ার দুই স্কুলপড়ুয়াও টোটোয় অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ তোলে সমাজমাধ্যমে। তাদের দাবি, তারা টোটোয় করে স্কুলে যাচ্ছিল। স্কুলের সামনে পৌঁছতেই তারা টোটোটিকে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু টোটোচালক গাড়ি না থামিয়ে তাদের নিয়ে এগিয়ে যায়। পরে কোনও ক্রমে তারা সেখান থেকে পালিয়ে স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছয়।
কাহিনি ৩: ২৩ জুলাই। এ বার এক স্কুলছাত্রী সমাজমাধ্যমে দাবি করে, টোটোয় করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় তাকে অপহরণের চেষ্টা হয়। স্কুলছাত্রীর দাবি, রাস্তায় তার টোটোয় মুখঢাকা এক ব্যক্তি উঠেছিলেন। ওঠার পর থেকেই নানা রকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন তাকে। এতেই তার সন্দেহ হয়। টোটোচালককে টোটো থামাতেও বলেছিল সে। কিন্তু টোটোচালক না থামায় বাধ্য হয়েই টোটো থেকে ঝাঁপ দিয়ে সে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিল বলে দাবি করেছে ওই নাবালিকা।
টোটোয় অপহরণের চেষ্টার এই একের পর এক অভিযোগে গত কয়েক দিন ধরে তোলপাড় শিলিগুড়ি। পুলিশের কাছে অবশ্য এই মর্মে লিখিত কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। যা হয়েছে, সবটাই সমাজমাধ্যমে। যার জেরে আতঙ্কের ছড়ায় জনমানসে। এই পরিস্থিতিতে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, সব ক’টি ঘটনাই ভুয়ো! সমাজমাধ্যমে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার একটিও সত্য নয়। তদন্ত করে তিনটি অভিযোগই খণ্ডন করে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট। পুলিশ জানিয়েছে, প্রথম কাহিনির তরুণী যা দাবি করেছিলেন, তা সাজানো! এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে জানা গিয়েছে, তরুণীর টোটোয় যে ব্যক্তি উঠেছিলেন, তিনি আদতে এক জন ভবঘুরে। এ ব্যাপারে এলাকার লোকজনের সঙ্গেও কথা বলে পুলিশ। তারা জানতে পারে, ওই দিন এলাকায় তরুণীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ওই ভবঘুরে ব্যক্তিটিকে এলাকার অনেকেই চেনেন। ভাড়া মেটানোর সময় টোটো যাত্রীদের থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে থাকলেও, তিনি কোনও ভাবেই অপহরণকারী নন।
পুলিশি তদন্তে দেখা গিয়েছে, দ্বিতীয় কাহিনির ওই দুই স্কুলছাত্রের গল্পেও জল মেশানো ছিল। সিসিটিভি ফুটেজে তদন্তকারীরা দেখেছেন, দুই নাবালক সে দিন টোটো করে স্কুলে যায়নি। হেঁটে গিয়েছিল। এনটিএস মোড় থেকে তাদের হেঁটে হেঁটে স্কুলে পৌঁছতে দেখা গিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজেই দেখা গিয়েছে, তৃতীয় কাহিনির ওই স্কুলছাত্রী যা দাবি করেছে, তা-ও সত্য নয়। ওই দিন সে যে টোটো করে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল, সেই টোটোয় মুখঢাকা কোনও ব্যক্তিই ওঠেননি। টোটো থেকে ঝাঁপ দেওয়ার গল্পও ফাঁদা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ওই নাবালিকা বাড়ির সামনেই টোটো থেকে নেমেছে। তার পর টাকা মিটিয়ে ভিতরে বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে।
শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসিপি (পূর্ব) দীপককুমার সরকার বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ গুজব রটানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের উদ্দেশে আমরা আগেও বলেছি, আবার বলছি, আপনারা অযথা আতঙ্কিত হবেন না। মুখঢাকা ব্যক্তির টোটোয় ওঠার কথা ঠিক নয়। এনটিএস মোড়ের ঘটনায় এক ভবঘুরেকে নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন। টোটোর যাত্রীদের থেকে টাকা কেড়ে নেওয়ার কাণ্ডও সে ঘটিয়েছে। তবে এ পর্যন্তই। এর বেশি কিছুই নয়। আর টোটো থেকে ঝাঁপ দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা-ও মিথ্যে। আমরা দেখেছি, মেয়েটি দিব্যি বাড়ির সামনে টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়েছিল।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, গুজব রটানোর এই প্রবণতার সূত্রপাত, সপ্তাহ দেড়েক আগে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্ট। সেই পোস্টে ১৬ জনের ছবি দিয়ে তাঁদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার দাবি করা হয়। এ-ও দাবি করা হয় যে, ওই ১৬ জনের অনেকেই নাকি টোটো থেকে অপহৃত হয়েছেন! যা থেকে আতঙ্ক ছড়ায়। তার পর থেকেই অপহরণের শিকার হতে হতে বেঁচেছেন বলে সমাজমাধ্যমে দাবি করতে শুরু করেন একের পর এক তরুণ, তরুণী। রটে যায় টোটোয় ঝাঁঝালো গন্ধের তত্ত্বও। সমাজমাধ্যমে দাবি করা হয়, টোটোয় উঠলেই ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! যার জেরে নাকি একাধিক স্কুলপড়ুয়া অসুস্থও হয়ে পড়েছে সম্প্রতি। সংজ্ঞাহীন করে অপহরণ করতেই টোটোয় গন্ধ ছড়ানো হয় বলে দাবি করা হয় সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টে।
তার প্রেক্ষিতে পুলিশের বক্তব্য, এ সবই গুজব। অপহরণ সংক্রান্ত দাবিকে জল-বাতাস দিতেই ঝাঁঝালো গন্ধের তত্ত্ব রটানো হয়েছে বাজারে। এই পরিস্থিতিতে সমাজমাধ্যমে গুজব, ভুয়ো খবর রুখতে তৎপর শিলিগুড়ি পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, এই ধরনের কোনও ঘটনার কথা কানে এলেই তারা পদক্ষেপ করে সত্য উদ্ঘাটন করেছে। সমাজমাধ্যম থেকে বিভ্রান্তিকর পোস্টগুলিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর যাঁরা গুজব রটাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
ডিসিপি (পূর্ব) দীপক বলেন, ‘‘একটা ঘটনার সঙ্গে আর একটা ঘটনা মিলিয়ে এই ধরনের গুজব রটানো হচ্ছে। কোনও এক সময় হয়তো সত্যিই নিরুদ্দেশ হয়েছিল। কিন্তু আবার একা একাই ফিরে এসেছে। কিন্তু ওই ঘটনাগুলো টেনে এনে নতুন গল্প ফেঁদে গুজব রটানো হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা আমরা ধরে ধরে সমাধান করেছি। আমরা কেস ফাইল করেছি। যাঁরা এই ধরনের গুজব ছড়াচ্ছেন, আমরা তাঁদের নোটিস পাঠিয়েছি। ডেকে পাঠানো হয়েছ তাঁদের।’’
যে ১৬ জনের নাম-ছবি দিয়ে নিখোঁজ পোস্টটি করা হয়েছিল, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শান্তনু শাহ, ফুলচাঁদ শা। শান্তনুর নম্বরে ফোন করে তাঁর কাকা রাকেশরঞ্জন শাহ ফোন ধরেছিলেন। রাকেশ বলেন, ‘‘নিখোঁজ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু দু’-তিন দিনের মধ্যেই তো বাড়ি চলে এসেছিল। আমিও সেই ফেসবুক পোস্ট দেখেছি। সেখানে আরও কয়েক জনের ছবি আছে, যাঁদের আমি চিনি। আমার এলাকারই বাসিন্দা। তাঁরাও নিখোঁজ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও তো ফিরে এসেছেন।’’ ফুলচাঁদের স্ত্রী-ও বলেন, ‘‘আমার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছিল। কিন্তু সে তো ফিরে এসেছে। এখন তো বাড়িতেই রয়েছে।’’
তদন্তকারীদের একাংশের মত, কম বয়সি ছেলেমেয়েরা যে ভাবে গল্প ফেঁদে গুজব রটাচ্ছে সমাজমাধ্যমে, তা যথেষ্টই উদ্বেগজনক। মূলত সমাজমাধ্যমে নজরে আসতে চেয়ে ও বন্ধুমহলে হাততালি কুড়োত চেয়েই তারা এ ধরনের কাজ করছে বলে মনে করছেন পুলিশ আধিকারিকেরা। এ প্রসঙ্গে মনোবিদ অরুণিমা ঘোষ বলেন, ‘‘বাচ্চারা সব সময়েই নানা রকম কল্পনার মধ্যে থাকে। কিছু বানানো গল্প-গুজব নিয়ে তারা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে। যখন গুজব রটাতে শুরু করেছে, তখন খুব স্বাভাবিক যে, তারাও এ সব নিয়ে আলোচনা করবে। কল্পনায় রং চড়াবে। সব সময় যে খারাপ উদ্দেশ্য থাকে, তা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের একটু সতর্ক হওয়া জরুরি।’’