অমর পাল
টালিগঞ্জের বাড়িতে ‘গানের ক্লাস’ শেষ হয়েছিল আধ ঘণ্টা আগে। তখনই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন তিনি। নাতনিরা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন দাদুকে। সেখানেই সব শেষ। শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় লোকশিল্পী অমর পালের জীবনাবসান ঘটল।
৯৭ বছরের নীরোগ প্রবীণের কণ্ঠে সুর ছেড়ে যায়নি কখনওই। অমরের পুত্রপ্রতিম, প্রিয় শিষ্য প্রাণেশ সোম বলছিলেন, ‘‘পয়লা বৈশাখের সকালেও গুরুজি গাইছিলেন, প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে গৌরচাঁদ খেলিয়া বেড়ায়! একবারটি আমায় বললেনও, ‘এ গান আর কে গাইবে বল তো! কত দিন থাকব জানি না, যেন গান গাইতে গাইতেই চলে যাই।’ ঠিক সেটাই ঘটলও।’’
গানকে আক্ষরিক ভাবেই যাপন করেছিলেন অমর। অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাইজপাড়ার ছেলেটি মায়ের কাছে অজস্র গান শিখেছেন। পিতৃহীন বালক পরে যাত্রায় বিবেকের পার্ট করতেন নিয়মিত। উস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের ভাই আয়াত আলি খানের সঙ্গ করে ধ্রুপদী সঙ্গীতে তালিম নেন অমর। দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে মণি চক্রবর্তীর কাছে শিক্ষা শুরু হয়। গানের নিজস্ব শৈলী অটুট রাখলেও নিজেকে শচীন দেব বর্মণ, আব্বাসউদ্দিনের ভাবশিষ্য বলতেন অমর। ‘মাটির শিল্পী’র প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে অজস্র গান গেয়েছেন। ‘সাগরসঙ্গমে’, ‘বাবা তারকনাথ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘শিউলিবাড়ি’র মতো ছবিতে রয়েছে তাঁর গান। দেশে ভোটপুজোর আবহে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’-য় চরণদাসের গানটি অনেকেরই মনে পড়ছে। ‘দেখ ভাল জনে রইল ভাঙা ঘরে, মন্দ যে
সে সিংহাসনে চড়ে’, শুনেই চোখমুখের ভাব পাল্টে গিয়েছিল উৎপল
দত্ত-অভিনীত হীরক রাজার। সেই কণ্ঠ এখন শুধুই স্মৃতি। অমরের চার ছেলে, তাঁদের পরিবারবর্গ রয়েছে। আজ, রবিবার বেলা ১২টা থেকে
কিছু ক্ষণ রবীন্দ্রসদনে অমরের দেহ শায়িত থাকবে।
সুধীর চক্রবর্তীর সংযোজন: পূর্ববঙ্গ গানের দেশ। সুরেন চক্রবর্তী, দীনেন্দ্র চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, খালেদ চৌধুরীদের মতো অমরের স্বরেও লোকগানের মাটির গন্ধ মিশে। ওঁদের সবাইকে কলকাতা পেয়েছে, এটা দেশভাগের একটা ভাল দিক।
লোকগানের শিল্পীরা অনেকেই নাটকে বা গণসঙ্গীতে শামিল হয়েছিলেন। রাজনীতির জগতের সংস্রবহীন অমরের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তবু সত্যজিৎ রায়ের মতো বিদগ্ধজন তাঁর ছবির প্লেব্যাকে অমরের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ যখন গাইছেন, তখন তিনি প্রবীণবয়সী। কিন্তু তখনও দাপটে গেয়ে চলেছেন। ঋজু কণ্ঠ। অসম্ভব সুরেলা। ভাটিয়ালি বা বৈষ্ণব ঘরানার গান— সব কিছুতে তাঁর কর্তৃত্ব অবাধ। এটাই অমরের গানের শৈলী।
তাঁর দীর্ঘজীবনের শেষেও মনে হয় অমরের প্রতিভার আরও বেশি ব্যবহার হতে পারত। অনেকের মতো লোকগানের মেজাজে তিনি আধুনিকতা চাপাতে চাননি। অমরের পরে এই গায়কীর বিশুদ্ধ সহজ ঘরানার পতাকা কে বহন করবেন, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকে গেল।