এই ছবি ঘিরেই যত বিতর্ক শুরু হয়েছে। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া।
তীব্র নিন্দা শুরু হল বসন্ত উৎসব কাণ্ডের। আঙুল উঠতে শুরু করল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দিকেও।
শিক্ষাবিদ থেকে সাহিত্যিক, মনোবিদ থেকে রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপক বা অন্য কলেজের অধ্যক্ষা— প্রত্যেকে সরব হলেন অশ্লীলতার বিরুদ্ধে। বসন্ত উৎসব পালন করতে গিয়ে যে ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিকৃত করা হয়েছে, যে ভাবে তার সঙ্গে অশ্লীল শব্দ জোড়া হয়েছে, তার ছবি গত ২৪ ঘণ্টা ধরে ঝড় তুলে দিয়েছে গোটা রাজ্যে। রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবের নিয়ন্ত্রণ আগে থাকত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে, বলছেন রবীন্দ্রভারতীরই একাধিক অধ্যাপক। তৃণমূলের জমানায় সেই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে ছাত্র সংসদ এবং তার পর থেকেই বার বার বসন্ত উৎসব ঘিরে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অধ্যাপকের।
রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী শুক্রবার বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন।তিনি বলেন, ‘‘বসন্ত উৎসবের সূচনা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন। সেইধারা মেনে আমরা রবীন্দ্রভারতীতে বসন্ত উৎসব পালন করি। কাজেই সেখানে যদি এ রকম কিছু ঘটনা ঘটে, তার থেকে দুঃখজনক কিছু আর হতে পারে না। এই সব ছবির সত্যতা যাচাই করার ক্ষমতা আমাদের নেই। পুলিশ এই ছবির সত্যতা যাচাই করে নেবে।’’ এর পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে কর্মসমিতিতে আমরা আলোচনা করব। আদৌ আর কখনও বসন্ত উৎসব পালন করতে পারব কি না, সেখানে বহিরাগতদের আদৌ প্রবেশাধিকার দেব কি না, সবটা নিয়েই আলোচনা হবে।’’
কিন্তু বিতর্কিত ছবিগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দেওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অধ্যাপকরা একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অধ্যাপকদের অধিকাংশই নাম প্রকাশ করতে চান না। প্রকাশ্যে মুখ খুললে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) রোষে পড়তে হতে পারে, এই আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। কোনও অধ্যাপক আবার বলছেন, ‘‘নিজের প্রতিষ্ঠান তো, তাই এ নিয়ে ফলাও করে মতামত দিতে যাওয়া উচিত হবে না।’’ তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিকৃতি ঘটানো, অশ্লীল শব্দ পিঠে লিখে ছবি তোলা-সহ যে সব কাণ্ড নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়েছে, কোনও দ্বিধা ছাড়াই তার নিন্দা করছেন প্রত্যেকে।
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রভারতীর দোল-কাণ্ডে চিহ্নিত ৫ পড়ুয়া, থানায় অভিযোগ, নিন্দা রাজ্য জুড়ে
রবীন্দ্রভারতীর এক স্বনামধন্য অধ্যাপকের কথায়, ‘‘এই বসন্ত উৎসব ছিল ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের অনুষ্ঠান। শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে হতঅনুষ্ঠানটা। অত্যন্ত নান্দনিক এবং রুচিশীল একটা অনুষ্ঠান হত। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সেই অনুষ্ঠানটাকে বাজারি করে তুলল। পুরো বসন্ত উৎসবের নিয়ন্ত্রণ ছাত্র সংসদ নিজেদের হাতে নিল। বিপুল সংখ্যক পাস ছাপিয়ে তা বিলি করতে লাগল। আশপাশের প্রচুর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়দের মধ্যে সেই পাস বিলিয়ে রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবে রবীন্দ্রভারতীকেই সংখ্যালঘু করে দিল। যে বছর থেকে এই কাণ্ড শুরু হল, সেই বছর থেকেই বসন্ত উৎসব নিয়ে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। প্রত্যেক বছর নানা আপত্তিকর ঘটনা ঘটছে।’’ ওই অধ্যাপকের কথায়, ‘‘রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসবকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক লাভ তুলতে চায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। প্রত্যেক বছর নিখরচায় যা খুশি করার জন্য একটা ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে বিভিন্ন কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নিজেদের সমর্থন বাড়াতে চাইছে।’’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকে তথা উপাচার্যের দিকেও আঙুল তুলছেন কেউ কেউ। তাঁদের মধ্যে এক অধ্যাপকের কথায়, ‘‘বসন্ত উৎসবের নিয়ন্ত্রণ ছাত্র সংসদ নিজের হাতে নিতে চাইল, আর কর্তৃপক্ষও দিয়ে দিলেন, এটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। বসন্ত উৎসবের মতো একটা অনুষ্ঠান, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে একটি ছাত্র সংসদকে রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। তাতে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।’’
অশ্লীল শব্দ পিঠে লিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের ওই ছবি পোস্ট মেনে নিতে পারছেন না সমাজের সকল স্তরের মানুষেরা
রবীন্দ্রভারতীর সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান দেবজ্যোতি চন্দ অবশ্য ছাত্র সংসদের উপরে পুরোপুরি দোষ চাপাতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক এবং পড়ুয়ারা মিলে গত এক মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটা দারুণ অনুষ্ঠান সাজিয়েছিলেন। ছাত্র সংসদও অবশ্যই চেয়েছিল যে, বসন্ত উৎসব খুব ভাল ভাবে মিটুক। কিন্তু বাইরে থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যাঁরা ঢুকলেন, তাঁরা অনেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি জানেন না। দারুণ একটা অনুষ্ঠানকে তাঁরা শেষ করে দিলেন।’’
কিন্তু এই হাজার হাজার বহিরাগতের জন্য বসন্ত উৎসবের দিনে ক্যাম্পাস উন্মুক্ত করে দেওয়ার নেপথ্যে কারা? তৃণমূল ছাত্র পরিষদ পরিচালিত ছাত্র সংসদ নয় কি? অধ্যাপক চন্দ বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, ছাত্র সংসদই পাস ছাপানো এবং বণ্টনের ব্যবস্থা করছে গত কয়েক বছর ধরে। তবে কোনও ছাত্রনেতাই চান না যে, তাঁর নিজের ক্যাম্পাসের বদনাম হোক।’’
আরও পড়ুন: বাড়ছে করোনা আতঙ্ক, বড় জমায়েত এড়িয়ে চলতে নির্দেশিকা জারি কেন্দ্রের
যে ভাবে বসন্ত উৎসব চলছে গত কয়েক বছর ধরে, সে ভাবে আর চলতে দেওয়া উচিত নয় বলে অবশ্য দেবজ্যোতি চন্দও একমত। তাঁর কথায়, ‘‘পর পর তিন বছরই ছাত্র সংসদ ব্যর্থ হল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা ছাত্রনেতারা করেছেন। কিন্তু তিন বারই ব্যর্থ। তাই এ ভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এই হাজার হাজার বহিরাগতকে বিনা বাছবিচারে পাস দেওয়া যায় না। আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণেই বসন্ত উৎসবের আয়োজন হওয়া উচিত। এবং পড়ুয়া ও শিক্ষকদের বাইরে আর কিছু বিশিষ্ট নাগরিকদের নিমন্ত্রণ করে এই অনুষ্ঠান হওয়া উচিত।’’
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। সংগঠনের সহ-সভাপতি মণিশঙ্কর মণ্ডলের কথায়, ‘‘যে ঘটনা বসন্ত উৎসবে ঘটানো হয়েছে, তাকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ একেবারেই সমর্থন করে না। এর সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কারও কোনও যোগ নেই। যারা এ সব নোংরামি করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে।’’ কিন্তু তৃণমূলের জমানায় বসন্ত উৎসবের নিয়ন্ত্রণ ছাত্র সংসদের হাতে যাওয়ার পর থেকেই এই সব কাণ্ড ঘটছে বলে যে অভিযোগ উঠছে, তা নিয়ে কী বলবেন? মণিশঙ্করের কথায়, ‘‘ও সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’’
গতকাল এই ছবি পোস্ট হতেই তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়
অধ্যাপকদের কেউ কেউ অবশ্য মানসিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। রবীন্দ্রভারতীর এক অধ্যাপকের কথায়, ‘‘পরিবার হল সভ্যতার শেষ আশা। সেই পরিবার যদি শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তা হলে আর সভ্যতার বাঁচার আশা থাকে না। অশ্লীল শব্দ বা বিকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত পিঠে লিখে যাঁরা ছবি তুললেন, আমি শুধু সেই ছেলেমেয়েদের দোষ দিতে চাই না। আমি তাঁদের বাবা-মা বা অভিভাবকদেরকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছি।’’ অভিভাবকদের উদ্দেশে ওই অধ্যাপকের প্রশ্ন, ‘‘কী শিক্ষা দিয়েছেন নিজের ছেলেকে বা মেয়েকে? আমার ছেলে বা আমার মেয়ে তো ওই রকম অশ্লীলতার প্রকাশ্য চর্চা করতে সাহস করবে না? আপনার ছেলে বা মেয়ে ওই ভাবে প্রকাশ্যে পিঠে অশ্লীল শব্দ বা বিকৃত কথাবার্তা লিখছে বা লেখাচ্ছে কী করে? সেই ছবি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার সাহসই বা হচ্ছে কী করে? বিন্দুমাত্র মূল্যবোধ কি তৈরি করতে পারেননি ওদের মধ্যে? বাবা-মা বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের চোখে পড়লে কী হবে, সেটাও কি ভাবে না? কাউকে কি পাত্তাই দেয় না? সবাইকে অবজ্ঞা করে?’’
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার এই ঘটনাকে বিকার হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়‘‘এ এক গণবিকার। ঠিক যে মানসিকতা থেকে নিজেই নিজের মরণের ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিচ্ছে কেউ কেউ, অৰ্থহীন হননের মানসিকতা, যা স্বার্থপর, যা কেবল দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, আকর্ষণের সারবত্তা নিয়ে ভাবে না। সমাজের সর্বত্র এই ধ্বংস আমরা দেখছি। অধর্ম, কুরাজনীতি ও অপসংস্কৃতির নীতিহীন সহাবস্থান। যারা এর বীজ বপন করতে চায়, তারা সহজ লক্ষ্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্বাচন করে।’’
আরও পড়ুন: হিন্দু হস্টেল ইস্যুতে রাস্তা আটকে আন্দোলন পড়ুয়াদের, চূড়ান্ত ভোগান্তি যাত্রীদের
শিক্ষাবিদ তথা কলেজ শিক্ষিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রভারতীর এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। আমি ভাবতে পারছি না, আমাদের এই অধোগতি কোথায় গিয়ে থামবে।’’ বৈশাখীর কথায়, ‘‘রবীন্দ্রভারতীতে আমি এক সময়ে পড়াতাম। তাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে। তবে শুধু সেই কারণে নয়, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে যোগ থাকা যে কোনও প্রতিষ্ঠানের আসনই আমার কাছে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা। সেই রকম একটা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে যে ছবি ধরা পড়ল, তাতে আমি স্তম্ভিত।’’
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষয়টির নিন্দা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই পড়ুয়ারা আসলে একটা উৎসবের সংস্কৃতিকে আঘাত করতে চেয়েছেন। অনেক সময় আমরা দেখেছি যে, ছাত্রছাত্রীরা একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাঁড়িয়েও চিরাচরিত প্রথা বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধতা জারি করে থাকে। কিন্তু এই প্রেক্ষিতে পুংলিঙ্গ সর্বস্ব যে ভাষা আমরা শিক্ষার্থীদের শরীরে দেখলাম, সাময়িক নজর আকর্ষণ ছাড়া তা আর কোনও অর্থ বহন করে কি না প্রশ্নসাপেক্ষ। কোনও অচলায়তনকে ঠেলার প্রয়োজন যদি থেকেও থাকে, তার পরিসর দেশের অনেক বৃহত্তর আন্দোলনের মধ্যে দিয়েও সংগঠিত করা যায়। অনেকেই তা করছেন। বৈপ্লবিকতার একমাত্র বহিপ্রকাশ কি গালাগাল?’’