—প্রতীকী চিত্র।
হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ। সামান্য কথা বলতে গেলেও হাঁফ ধরে। দিনের বেশির ভাগ সময় এখন তাঁর কাটে ঘরের সামনের উঠোনে পাতা চৌকিতে শুয়ে বা চেয়ারে বসে। দত্তপুকুরের বিস্ফোরণস্থলের দু’টি বাড়ি পরের বাসিন্দা এমনই এক বৃদ্ধের থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিস্ফোরণ হল কী ভাবে? প্রশ্ন শুনেই তাঁর স্ত্রী টেনে সরিয়ে দিলেন বৃদ্ধের গায়ের চাদর। দেখা গেল, মাটিতে সাপবাজি পোড়ালে যেমন কালো ছোপ পড়ে, অনেকটা তেমনই দাগ তাঁর শরীরের একাধিক জায়গায়!
বৃদ্ধা বললেন, ‘‘এই লোকও বাজি কারখানায় কাজ করত। বারুদের বিষ বাতাসে থেকে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে পারে না।’’ ইতিমধ্যেই ওই বৃদ্ধ দু’বার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কথা জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর।
বৃদ্ধ একা নন। ইছাপুর-নীলগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মোচপোল, কাঠুরিয়া, বেরুনানপুকুরিয়ার মতো উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক ‘বাজি মহল্লা’ জুড়ে এমনই নানা রোগের ছবি। ঘরে ঘরে সব চেয়ে বেশি চর্মরোগ। শরীরে গভীর ঘা বা ফোস্কা এখানে ‘জলভাত’। অভিযোগ, এই কাজের জন্য সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক ছাড়া কখনও রোগাক্রান্তদের ওষুধ দিয়ে সাহায্য করা হয়নি। অথচ ঘরে ঘরে শ্বাসনালি, ফুসফুসের সমস্যা। চোখের প্রদাহ নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। অল্প বয়সে চোখে ছানি পড়ার রোগীও এখানে আছেন।
মোচপোলের পশ্চিমপাড়ায় বিস্ফোরণস্থলের কাছেই থাকেন রহমত আলি। তিনি বলছিলেন, ‘‘এক সময়ে এখানকার নারায়ণপুরের বাজি ব্যবহার হত শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই বা অশুভ আত্মার দূরীকরণে। পরে কালীপুজোয় এখানকার বাজির ব্যবহার শুরু হল। বাজির কুফল সম্পর্কে ভাবনাচিন্তাও বন্ধ হয়ে গেল।’’ ওই এলাকার চিকিৎসক, আর এক রহমত আলি বলেন, ‘‘বাজির জ্বলনে নাইট্রাস অক্সাইড দীর্ঘ সময় বায়ুমণ্ডলে থেকে বাতাস দূষিত করে। ওই দূষণ দূর হয় শুধু ভারী বৃষ্টি ও প্রবল ঝড়েই। বিস্ফোরণের পর থেকে এই তল্লাটে তেমন বৃষ্টি হয়নি। ফলে বারুদের বিষে বাতাস এখনও ভারী।’’
পরিবেশকর্মীদের মতে, বাজিতে ব্যবহৃত তামা হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ তৈরি করে। ক্যাডমিয়াম রক্তে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়। জ়িঙ্ক বা দস্তার জন্য বমি ও প্রবল জ্বর হতে পারে। সিসা স্নায়ুর ক্ষতি করে। এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং সালফারের বিভিন্ন যৌগ দিয়ে বাজি তৈরি হয়। ফলে বাজি তৈরির সময়ে মানবদেহের যা ক্ষতি হয়, সেটা পোড়ানোর ক্ষতির চেয়ে কম নয়। বড় মাপের বাজি বিস্ফোরণে বিপদ স্বভাবতই বেড়ে যায়।’’
বক্ষরোগ চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘সাধারণত ঘুপচি ঘরে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাজির কাজ চলে। এই পরিস্থিতিতে শ্বাসের মাধ্যমে টানা রাসায়নিক শরীরে ঢোকায় ফুসফুসের ক্ষতি হবেই। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে, বাড়বে বুকের বিভিন্ন সংক্রমণ।’’ তিনি আরও জানান, ছোটদের শরীরে ক্ষতি আরও বেশি। অপরিণত ফুসফুসে এমন রাসায়নিক ঢোকার ফল হয় আরও মারাত্মক। চর্মরোগ চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ীর মন্তব্য, ‘‘বাজি তৈরির প্রায় সব কারখানাই বেআইনি হওয়ায় নিয়ম মানার বালাই থাকে না। কর্মীদের মারাত্মক ঘা, চামড়ার পাকাপাকি ক্ষতি হওয়ারও প্রভূত আশঙ্কা থাকে।’’ চক্ষু চিকিৎসক জ্যোতির্ময় দত্তের আবার দাবি, ‘‘বাজি তৈরির সঙ্গে যুক্তদের চোখে অ্যালকালি বা অ্যাসিড বার্নের ঝুঁকিও প্রবল। গরম ও ধাতব যৌগ চোখের ক্ষতি করতে পারে। দৃষ্টিশক্তিও সম্পূর্ণ চলে যেতে পারে।’’
তা হলে উপায়? পরিবেশকর্মী নব দত্ত বললেন, ‘‘আগে সব বেআইনি কাজ বন্ধ করতে হবে। তার পরে পর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বাজি তৈরি করা যায় কি না, দেখতে হবে।’’ বাজি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির অবশ্য দাবি, প্রায়ই স্বাস্থ্য শিবির করে থাকেন তাঁরা। প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু যে ব্যবসায় শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যু ঘটে, সেখানে এমন শিবিরের কী মূল্য? উত্তর মেলেনি। নারায়ণপুরেই বাজি বিস্ফোরণে এক সময়ে দৃষ্টি হারানো মতিউর শেখ বলছিলেন, ‘‘কোনও কাজই করতে পারি না। চোখে দেখি না, তবুও বাজির বিষের জ্বালা পিছু ছাড়ে না।’’