নিশানায় নবান্নের উঁচুতলা

এত দিন কী করছিল প্রশাসন, কর্তাদের প্রশ্ন করবে সিবিআই

সিবিআইয়ের আতসকাচের নীচে এ বার খাস নবান্ন! সারদা কেলেঙ্কারিতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের শিকড় খুঁজতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে সিবিআই। এ বার এই কেলেঙ্কারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন কী ভূমিকা পালন করেছে, তা খতিয়ে দেখার ইঙ্গিত দিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এ জন্য নবান্নের একাধিক কর্তাকে ডেকে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী ও দেবজিৎ ভট্টাচার্য

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

সিবিআইয়ের আতসকাচের নীচে এ বার খাস নবান্ন!

Advertisement

সারদা কেলেঙ্কারিতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের শিকড় খুঁজতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে সিবিআই। এ বার এই কেলেঙ্কারিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন কী ভূমিকা পালন করেছে, তা খতিয়ে দেখার ইঙ্গিত দিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এ জন্য নবান্নের একাধিক কর্তাকে ডেকে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

সিবিআই বুঝতে চায়, সারদার প্রতারণা রুখতে রাজ্য সরকার তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছে কি? নাকি সব জেনেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিল প্রশাসন? কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তার কথায়, “বেআইনি কারবার বন্ধ করতে গত তিন বছরে দিল্লি যত চিঠি দিয়েছে রাজ্যকে, তার কোনও উত্তর পায়নি কেন্দ্র।” সিবিআই-এর এক শীর্ষকর্তার দাবি, “নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমরা মনে করছি, রাজ্য প্রশাসনের কিছুই অজানা ছিল না।”

Advertisement

রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানান, এই সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে ছ-ছ’টি চিঠি দিয়েছে। একটিরও উত্তর যায়নি দিল্লিতে। ওই কর্তা বলেন, “সব ক’টি চিঠির বয়ানই কার্যত একই রকম। লগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি আর্থিক লেনদেন ঠেকাতে রাজ্য কী পদক্ষেপ করেছে, সে কথাই জানতে চেয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।”

কেন দিল্লির একটিরও চিঠির জবাব দিল না স্বরাষ্ট্র দফতর? দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “আর্থিক বিশৃঙ্খলা দেখার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। অর্থ দফতরই এ ব্যাপারে পারদর্শী।” ওই অফিসারের কথায়, আর্থিক অপরাধ দমনশাখা অর্থ দফতরের অধীনে। অর্থ দফতরই নিয়মিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি-র সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। ফলে তাঁঁর দাবি, “লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম অর্থ দফতরেরই জানার কথা। সে কথা মাথায় রেখেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাঠানো চিঠির জবাব দেওয়ার দায়িত্ব অর্থ দফতরের।” অর্থ দফতর কী করেছে? নবান্ন সূত্র বলছে, লগ্নি সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে রাজ্য সরকার যে নতুন আইন করতে উদ্যোগী হয়েছে, গত বছর সে কথাই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি-কে জানিয়েছিল অর্থ দফতর। কিন্তু বেআইনি লেনদেনের অভিযোগে ঠিক কতগুলো লগ্নি সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তার কোনও তথ্য কিন্তু দিল্লি পায়নি বলেই সিবিআই সূত্রের খবর। ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সেবি-র পাঠানো একাধিক চিঠি ধরেও রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা যাচাই করতে চাইছে তারা।

২০১২-১৩ সালের অর্থ দফতরের রিপোর্ট বলছে, ২০১১-এর ১ এপ্রিল থেকে ২০১৩-এর ৩১ মার্চের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা ফেরত না পাওয়া সংক্রান্ত ৯৫টি অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে আট জন লগ্নিকারীকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়, যার পরিমাণ ২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৯৪৯ টাকা। প্রশ্ন হল, অর্থ দফতর যদি সমস্যার সুরাহা করেই ফেলে থাকে, তা হলে সারদা কমিশন তৈরি হওয়ার পরে লগ্নির টাকা ফেরত পেতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল কেন? আবেদনকারীর সংখ্যাটা এক ঝটকায় বেড়ে ১৭ লক্ষে দাঁড়াল কেন? প্রশাসনের অন্দরেই একাংশের কটাক্ষ, বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলির দাপাদাপি বন্ধ করতে অর্থ দফতর কতটা সক্রিয় ছিল, এই সংখ্যাতত্ত্বই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে!

সিবিআই কর্তাদের ব্যাখ্যা, সারদা-র মতো সংস্থাগুলির বেআইনি কারবার রোখার প্রধান দায়িত্ব সেবি-রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-কোম্পানি নিবন্ধকের। কিন্তু রাজ্য পুলিশের কাছে কেউ প্রতারিত হয়ে অভিযোগ জানালে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০-র মতো বিভিন্ন ধারায় ওই সংস্থা এবং তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। তাকে গ্রেফতার করাও যেতে পারে। ওই সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে পুলিশ। প্রশ্ন উঠেছে, সারদার রমরমার সময় মমতার পুলিশ কী ভূমিকা নিয়েছিল?

বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কারবার রুখতে ২০০৪ সালে বাম জমানায় অর্থ দফতরে একটি ইকনমিক অফেন্স উইং সেল তৈরি হয়েছিল। সেই সেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাক্তন পুলিশকর্তা নারায়ণ ঘোষকে। সারদার উত্থানের পর তিনি সেবি-র কাছে অভিযোগও জানিয়েছিলেন। ২০১১ সালে নারায়ণ ঘোষ ওই সেল থেকে সরে যাওয়ার পরেই সেটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সারদার ঘটনার পরেও তাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেনি নতুন সরকার। তবে দময়ন্তী সেন ডিসি (ডিডি) থাকাকালীন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করেছিল। বিজ্ঞাপনে ভুল তথ্য দিয়ে লোক ঠকানো হচ্ছে কি না, তারও তদন্ত হয়েছে।

২০০৭-’০৮ সাল থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদে সাধারণ মানুষের থেকে টাকা তুলতে শুরু করে সারদা। কোথাও জমি, কোথাও ফ্ল্যাট-বাড়ি, কোথাও আবার পর্যটনের প্যাকেজের বিনিময়ে লগ্নি নেওয়া হয়। পাঁচ বছর পর লগ্নিকারীরা ঠকে গিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে শুরু করেন। অর্থাৎ, সারদার বিরুদ্ধে অধিকাংশ অভিযোগ জমা পড়ে নতুন জমানাতেই। সারদা-সহ বহু সংস্থার বিরুদ্ধে রাজ্যের বিভিন্ন থানাতেই অভিযোগ জমা পড়ে। সেই সব এফআইআর-এর তথ্য রাজ্য পুলিশের তরফে সিবিআইয়ের হাতে তুলেও দেওয়া হয়েছে। ফলে সিবিআই মনে করছে, সারদার কাজকর্ম অজানা ছিল না পুলিশ-প্রশাসনেরও। তবে সামগ্রিক ভাবে সারদা কেলেঙ্কারি রোখার যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে কিছু তথ্যও মিলেছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। কী সেই তথ্য?

• ২০১০ সালেই রাজ্যের ইকনমিক অফেন্স উইং সেলের তরফে সেবি-কে সারদা-র বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয়। কাজেই বাম জমানায় সারদা-র বেআইনি কাজ কারবার সম্পর্কে জানা ছিল প্রশাসনের। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে সারদা-র বিরুদ্ধে নির্দেশিকাও জারি করেছিল সেবি।

• ২০১২ সালে কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ জালিয়াতি তদন্ত সংস্থা (এসএফআইও) পশ্চিমবঙ্গে সারদা-সহ সব বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কাজকারবার নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে নেমে তারা রাজ্য সরকারের কাছে বহু বার বিভিন্ন রকম তথ্য চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু কোনও তথ্যই মেলেনি।

• বেসরকারি লগ্নি সংস্থাগুলির উপরে নজরদারি ও তাদের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণে রাজ্যস্তরে যে ‘কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ (এসএলসিসি) আছে, তাতে সিআইডি এবং রাজ্য অর্থ দফতরের একাধিক প্রতিনিধি রয়েছেন। সেখানে প্রায় সব বৈঠকেই এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তাতে রাজ্যের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি।

• ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তদানীন্তন গভর্নর ডি সুব্বারাও কলকাতায় গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্য সরকারকে নিজে থেকেই আর্থিক লগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

• ২০১৩ সালে রাজ্য স্তরে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের বৈঠকে (এসএলবিসি) সারদা-র মতো সংস্থাগুলির কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভাস্কর সেন। সেখানে হাজির ছিলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। ছিলেন সারদা মামলায় ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষও। কুণাল কেন ওই সম্মেলনে গিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

• ওই বৈঠকে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের চাপে অর্থ দফতর জানিয়েছিল, সমস্ত জেলা শাসকদের কাছ থেকে সারদা-র মতো সংস্থাগুলির কাজকারবার নিয়ে রিপোর্ট চাওয়া হবে। কোনও রিপোর্ট এসে পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ।

• ২০১১ সালে তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্র প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। ২০১২ সালে কংগ্রেস নেতা আবু হাসেম খান চৌধুরী এই সংস্থাগুলির সঙ্গে তৃণমূল যোগসাজশ নিয়ে মনমোহন সিংহকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানান।

সিবিআই কর্তারা বলছেন, সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কোম্পানি নিবন্ধকের কিছু কর্তা-কে সুদীপ্ত সেন মাসোহারা পাঠাতেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তাই ওই সংস্থাগুলিও নিজেদের ভূমিকা ঠিক মতো পালন করেনি বলে মনে করা হচ্ছে। একই ভাবে রাজ্য প্রশাসনও কেন চোখ বুজে ঠুঁটো হয়ে বসে রইল তা-ও বোঝা দরকার। সিবিআই সূত্র বলছে, বাম জমানায় কী হয়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা ছাড়া অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধেও তদন্ত করবে সিবিআই। প্রাথমিক ভাবে সারদা-র বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছে। সিবিআইয়ের বর্তমান অধিকর্তা রঞ্জিৎ সিন্হা নভেম্বরে অবসর নেবেন। তার আগে তিনি সারদা-র তদন্ত সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পেশ করে যেতে চান।

সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা এমন নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। তাঁর বক্তব্য, “আমি কিছু বলব না।” রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ফোনই ধরেননি। প্রতিক্রিয়া জানতে তাঁকে এসএমএস করা হলেও রাত পর্যন্ত জবাব মেলেনি। একই ভাবে প্রাক্তন অর্থসচিব (নতুন সরকারের শুরুতে তিনি ছিলেন অর্থসচিব) চঞ্চলমল বাচওয়াতও ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব দেননি। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বরাবরই বলেছেন, সারদা-র মতো সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত শুরু হয় বাম জমানাতেই। তিনি এসে এদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সুদীপ্ত সেনকে গ্রেফতারও করেছেন।

সোমবার চৌরঙ্গি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচারসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “প্রতি বার নির্বাচনের আগেই সারদা নিয়ে হইচই হয়। বিধানসভা উপনির্বাচনের আগেও তা-ই হচ্ছে। কিন্তু সর্বত্র তৃণমূলই জিতেছে।”

সহ প্রতিবেদন: পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement