কর্পোরেট সংস্থায় যা দস্তুর, শেষ পর্যন্ত সেই কায়দাই শুরু হল সিপিএমে। নিজেদের কাজের মূল্যায়ন নিজেরাই করলেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা। আত্মবিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সুপারিশ হল সম্পাদকমণ্ডলী থেকে কয়েক জনকে অব্যাহতি দেওয়ার।
দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের কাজের বিশ্লেষণ করতে হবে বলে আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল সিপিএমে। কর্পোরেট সংস্কৃতিতে যে ভাবে কর্মীদের ‘সেল্ফ অ্যাপ্রাইজাল’ হয়, অনেকটা সেই কায়দায়। আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো নেতারা এ রাজ্যে দলে থাকার সময়ে অবশ্য বারবারই প্রশ্ন তুলতেন, শুদ্ধকরণ-সহ সব কাজই কেন নিচু তলা থেকে শুরু হবে? পচন তো ধরেছে মাথা থেকে! শেষ পর্যন্ত দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী আগে নিজেদের মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করে দলে নজির তৈরির চেষ্টা করেছে। প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে দলের সদ্য অনুষ্ঠিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে সেই রিপোর্ট পেশও করা হয়েছে।
সিপিএম সূত্রের খবর, প্রশ্নোত্তরের ধাঁচে ফর্ম দেওয়া হয়েছিল সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের। তাঁরা যা যা উত্তর দিয়েছেন, তার সঙ্কলন করে আবার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী আলোচনা করে রিপোর্ট তৈরি করেছে। সেখানেই রাজ্য নেতৃত্বের কাজের ভুল-ত্রুটি উল্লেখ করে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে, দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। বয়সজনিত কারণেই হোক বা দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা— কারও কারও যে অব্যাহতি প্রয়োজন, সেই কথাও বলা আছে রিপোর্টে। তবে অহেতুক বিতর্ক এড়ানোর জন্যই রিপোর্টে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কোনও সদস্যের নাম রাখা হয়নি। ভাল-মন্দ, সবটাই দেখানো হয়েছে কমিটি হিসাবে সামগ্রিক ভাবে।
ইদানীং কালে সিপিএমের সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে সব চেয়ে বড় সমস্যা নিষ্ক্রিয়তা। কিন্তু রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ক্ষেত্রে সমস্যা ঠিক তেমন নয়। তারা প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বৈঠক করে। কখনও কখনও দু’বেলা টানা আলোচনা করে। আবার প্রতি দিনই আলিমুদ্দিনে উপস্থিত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যেরা ঘরোয়া ভাবেও আলোচনা করে নেন বিভিন্ন বিষয়ে।
তা হলে কাজের ব্যর্থতা কোথায়? আত্মমূল্যায়নের রিপোর্ট বলছে, গণসংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে কর্মসূচি বা আন্দোলনের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কারও কারও গাফিলতি থাকছে। সম্পাদকমণ্ডলীর প্রত্যেক সদস্যই কোনও না কোনও জেলার দায়িত্বে আছেন। জেলার নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয়ে কারও কারও সমস্যা হচ্ছে। কেউ কেউ জেলায় গিয়ে বৈঠক করেই দ্রুত ফিরে আসছেন। তাতে কাজের কাজ হচ্ছে না। কারও দৌড়ঝাঁপে বাধা হচ্ছে বয়স বা অসুস্থতা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভুল মেনে নিয়ে বা সমস্যা স্বীকার করে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের একাংশের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির প্রস্তাবে সম্পাদকমণ্ডলী নিজেরাই সায় দিয়েছে!
দলের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে দুই নেতা রাজ্য নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। এক জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি আলিমুদ্দিনের বাইরে এখন প্রায় পা না দিলেও দল তাঁকে অব্যাহতি দেয়নি সম্পাদকমণ্ডলী থেকে। শারীরিক কারণে কলকাতার নেতা রঘুনাথ কুশারী দায়িত্ব থেকে ছাড় পেয়েছেন। দলের অন্দরের একটি সূত্রের
ইঙ্গিত, এ বার দীপক দাশগুপ্ত, নৃপেন চৌধুরী, দীপক সরকার বা মিনতি ঘোষের মতো নেতা-নেত্রীর ‘অব্যাহতি’ নিয়ে চর্চা আছে।
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘কাকে কবে কী ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হবে, তার সময়সীমা এখনও ঠিক হয়নি। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে যে প্রক্রিয়া দরকার ছিল, তা সম্পূর্ণ হয়েছে।’’ সম্পাদকমণ্ডলীই ভাবনা হাতে নিয়েছে, টানা কয়েক বছর কোনও রাজ্য নেতাকে কোনও জেলার দায়িত্বে না রেখে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ বার থেকে ভার দেওয়া যেতে পারে। সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, এ বার রাজ্য কমিটির সদস্যের কাছে প্রশ্নোত্তর পৌঁছবে। তার পরে মূল্যায়ন নামবে আরও নিচু তলায়।