‘জেলে যেতেও রাজি, শিক্ষিকা ছাড়তে পারব না’

একমাত্র শিক্ষিকাকে ছেড়ে দিলে বিপাকে পড়বে মাধ্যমিক দিতে চলা স্কুলের ১১ জন ছাত্রী। কারণ, তাদের পরীক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত করার এক্তিয়ার থাকবে না আর কারও।

Advertisement

শমীক ঘোষ 

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৮
Share:

মৃত্যুঞ্জয়নগর বালিকা বিদ্যানিকেতন।

স্কুলের একমাত্র স্থায়ী শিক্ষিকা বদলি নিয়ে চলে যেতে চান অন্যত্র। জেলা স্কুল পরিদর্শক তাঁকে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিয়েছে। অন্য স্কুলে তাঁকে নিয়োগপত্রও দিয়ে দিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। কিন্তু রিলিজ অর্ডার দিতে রাজি নন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর থানার মৃত্যুঞ্জয়নগর বালিকা বিদ্যানিকেতন হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি অজিতকুমার সাহু। এমনকি আদালতের নির্দেশেও নয়। তাতে জেল হয় হোক। কিন্তু একমাত্র শিক্ষিকাকে ছেড়ে দিলে বিপাকে পড়বে মাধ্যমিক দিতে চলা স্কুলের ১১ জন ছাত্রী। কারণ, তাদের পরীক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত করার এক্তিয়ার থাকবে না আর কারও।

Advertisement

অজিতবাবুকে আদালত অবমাননার দায়ে জেলে পাঠায়নি কলকাতা হাইকোর্ট। তবে স্থগিত করেনি ওই শিক্ষিকার বদলিও। হাইকোর্ট বলেছে, তার রায়কেই ওই শিক্ষিকার ‘রিলিজ অর্ডার’ হিসেবে গণ্য করে পরবর্তী পদক্ষেপ করতে হবে। যা শুনে অজিতবাবুর মন্তব্য, ‘‘ভগবান ছাড়া ওই ১১ জন পরীক্ষার্থীকে বাঁচানোর আর কেউ নেই।’’

কেন এই জটিলতা? স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) সূত্রের খবর, কসবার হালতুর বাসিন্দা আলোলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সাগরের ওই স্কুলে শিক্ষকতা করার নিয়োগপত্র পান ২০১১ সালে। তখন স্কুলে আরও কয়েক জন স্থায়ী শিক্ষিকা ছিলেন। কিন্তু একে একে তাঁরা সকলেই বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ওই স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা এখন ৮৩। তাদের পড়ানোর জন্য স্থানীয়দের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে আট জন আংশিক সময়ের শিক্ষিকা নিযুক্ত করেছে পরিচালন সমিতি। তবে স্থায়ী শিক্ষিকা এক জনই— আলোলিকা। তিনিই টিচার-ইন-চার্জ।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল বাবা-মা-মেয়ের

সাগরের এই স্কুলটির দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। তা-ও এক বাসে বা ট্রেনে যাওয়ার উপায় নেই। প্রথমে শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ট্রেন। সেখান থেকে অটোয় ৮ নম্বর লট। তার পর ভেসেলে মুড়িগঙ্গা পেরনো। ও-পারে কচুবেড়িয়ায় নেমে বাসে চড়ে রুদ্রনগর। সেখান থেকে টোটোয় সওয়ার হয়ে মৃত্যুঞ্জয়নগর। সব মিলিয়ে অন্তত ৪ ঘণ্টার ধাক্কা।

আরও পড়ুন: খোঁজ মিলল তিন বছর আগে চুরি যাওয়া শিশুর

প্রতিদিন এতটা পথ পাড়ি দিতে অসুবিধা হওয়ায় ২০১৪ সাল নাগাদ আলোলিকাও জেলা স্কুল পরিদর্শকের কাছ ‘নো-অবজেকশন’ নিয়ে বদলির আবেদন জানান এসএসসি-র কাছে। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর এসএসসি সেই আবেদন মঞ্জুর করে তাঁকে মগরাহাটের বেলোমণি হাইস্কুলে বদলি করে। বলা হয় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মগরাহাটের স্কুলে যোগ দিতে। কিন্তু তাঁকে ‘রিলিজ অর্ডার’ দিতে রাজি হননি অজিতবাবু।

তখন হাইকোর্টে মামলা করেন ওই শিক্ষিকা। গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি অরিন্দম সিংহ নির্দেশ দেন, ‘রিলিজ অর্ডার’ দিতে হবে পরিচালন সমিতিকে। তা সত্ত্বেও অর্ডার পাননি আলোলিকা। তাঁর আইনজীবী এক্রামুল বারি জানান, এর পরে আদালত অবমাননার মামলা হয়। তাতে অজিতবাবুর আইনজীবী অঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, বিচারপতির নির্দেশ অমান্যের জন্য তাঁর মক্কেল নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী। এ জন্য তিনি জেলে যেতেও রাজি। কিন্তু রিলিজ অর্ডার দিতে পারছেন না। কারণ, মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিন কোনও শিক্ষককে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের চিহ্নিত করতে হয়। সই করতে হয় ‘ডেসক্রিপটিভ রোল’-এ। আলোলিকাদেবী চলে গেলে সেই কাজ করার কেউ থাকবে না।

বিচারপতি সিংহ সে কথা শুনে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্তকে নির্দেশ দেন, এসএসসি কর্তৃপক্ষ ওই স্কুলে অন্য কোনও শিক্ষিকাকে পাঠাতে পারেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে। ১৭ ডিসেম্বর সরকারি কৌঁসুলি এসএসসি কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট পেশ করে জানান কোনও শিক্ষিকাই ওই স্কুলে যেতে রাজি হচ্ছেন না। সে দিনই তাঁর রায়কে ‘রিলিজ অর্ডার’ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেন বিচারপতি।

বৃহস্পতিবার সেই রায়ের কপি হাতে নিয়ে অজিতবাবুর আক্ষেপ, ‘‘স্কুলটা বোধহয় এ বার উঠেই গেল!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement