রাজভবনে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সায়ন কর্মকার। —নিজস্ব চিত্র।
বড় চাকরি মিলেছে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)-য়। কিন্তু সেই সুযোগ হাতছাড়া হতে বসেছিল শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য না-থাকার কারণে! বিভিন্ন দরজায় কড়া নেড়েও সুরাহা হয়নি। চাকরির আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন ওই পড়ুয়া। শেষ চেষ্টা করতে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজভবনে। কিন্তু কোথায় যাবেন, কী করবেন বুঝতে না পেরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন উদ্ভ্রান্তের মতো। সেই সময়েই আনন্দবাজার অনলাইনের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর দেখা। আনন্দবাজার অনলাইনই প্রথম খবর করে ওই পড়ুয়াকে নিয়ে। তাঁকে রাজ্যপালের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে। রাজভবনে সেই সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই পাকা হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই পড়ুয়া সায়ন কর্মকারের চাকরি।
বৃহস্পতিবারই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ফলে, উপাচার্যের সই থাকা শংসাপত্র হাতে পেতে আর সমস্যা হওয়ার কথা নয় হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা সায়নের। তিনিই জানালেন, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী সোমবারই বিশ্ববিদ্যালয় তরফে শংসাপত্র পাবেন তিনি। সেই শংসাপত্র হাতে এলেই তা জমা দিয়ে ডিআরডিওর চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন। এর প্রেক্ষিতে রাজ্যপাল বোস বলেন, ‘‘আপনাদের মারফতই প্রথম সায়ন কর্মকারের খবরটা পাই। এত বড় চাকরি পেয়েও উপাচার্যের অভাবে তিনি চাকরি করতে পারবেন না! এটা আমি কোনও দিন হতে দেব না।’’ চাকরিতে যোগ দিতে কোনও বাধা না-থাকায় মুখের হাসি চওড়া হয়েছে সায়নের। শুক্রবার রাজভবনে আনন্দ বোসের সঙ্গে দেখাও করেন ওই পড়ুয়া। সাক্ষাতের পর তিনি বলেন, ‘‘বাবা-মায়ের স্বপ্ন অবশেষে পূরণ করতে পারব, ভাবিনি কখনও। আজকের দিন স্বপ্নের মতো কাটল। সারা জীবন মনে রাখার মতো দিন। আনন্দবাজার অনলাইনের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।’’
২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা একটি কলেজ থেকে ফোটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করেন সায়ন। সম্প্রতি তিনি ডিআরডিওয় ফোটোগ্রাফার পদের পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। কিন্তু ফাঁপরে পড়েন নথি যাচাইয়ের সময়। তিনি যে ফোটোগ্রাফি নিয়েই পড়াশোনা করে পাশ করেছেন, তার কোনও শংসাপত্র নেই। মে মাস থেকে উপাচার্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই শংসাপত্রে সই করারও কেউ নেই! তার পর থেকেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সায়ন। কেউ যদি তাঁর শংসাপত্রের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। শেষমেশ গিয়েছিলেন রাজভবনে। রাজ্যপাল বোসের সঙ্গে দেখা করে নিজের সমস্যার কথা জানাতে। গত ২৫ অগস্ট রাজভবনের সামনেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় সায়নকে। তিনি জানান, ডিআরডিও-তে চাকরি পেয়েও তা হাতছাড়া হতে বসেছে। উপাচার্যের সই করা শংসাপত্র না-থাকায় নথি যাচাইয়ের সময় তাঁর চাকরি আটকে গিয়েছে। তার জন্য তিন মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোরাঘুরি করেও কাজ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং রাজ্যপালকেও বার বার মেল করেছিলেন। কিন্তু কোনও উত্তর আসেনি। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই সশরীরে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছেন। কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন রাজভবনের ‘সিকিওরিটি কাউন্টার’-এ।
এই নিয়ে প্রথম খবর করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তার পর কেটে যায় আরও তিন দিন। রাজভবন বা বিশ্ববিদ্যালয়— কোনও জায়গা থেকেই আশার আলো দেখতে না পেয়ে গত মঙ্গলবার সায়নকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, একমাত্র উপাচার্য নিয়োগ হলেই শংসাপত্র পেতে পারেন সায়ন। তা ছাড়া অন্য কোনও ভাবেই তা সম্ভব নয়। এর পর আনন্দবাজার অনলাইনের উগ্যোগেই রাজ্যপালের ওএসডি সন্দীপ রাজপুতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সায়ন। রাজ্যপাল অবশ্য তখন দিল্লিতে ছিলেন। সমস্যার কথা শুনে ওএসডি-ই সায়নকে কাগজপত্র জমা দিতে বলেন। সেই মতো বুধবারই হোয়াটস্অ্যাপে সমস্ত জরুরি কাগজপত্র জমা দেন সায়ন। এর পর বৃহস্পতিবার রাতেই খবর এল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করেছেন রাজ্যপাল বোস। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী উপাচার্য রাজকুমার কোঠারিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হল। যার অর্থ, চাকরির জন্য জরুরি শংসাপত্র পেতে সায়নের আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সায়ন জানান, বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁকে রাজভবন থেকে জানানো হয় যে, রাজ্যপাল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেই মতো শুক্রবার রাজভবনে যান তিনি। সাক্ষাতের পর সায়ন বলেন, ‘‘সোমবারই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের হাত থেকে শংসাপত্র নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব।’’
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগই নয়, রাজভবন সূত্রে খবর, উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের নানা সমস্যা দূর করতে রাজ্যপালই উপাচার্যের ভূমিকা পালন করবেন। নতুন অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চলবে। রাজভবনের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, পড়ুয়ারা দরকারে ইমেল বা রাজভবনের শান্তিকক্ষে ০৩৩২২০১৬৪২ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানাতে পারবেন। ‘আমনে-সামনে’ কর্মসূচির মাধ্যমে অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করে পড়ুয়ারা রাজভবন বা সার্কিট হাউসে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন পড়ুয়ারা। শুক্রবার আনন্দ বোস বলেন, ‘‘অনেক সমস্যা থাকলেও জরুরি ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সোমবারের মধ্যেই প্রয়োজনীয় শংসাপত্র হাতে পেয়ে যাবেন সায়ন কর্মকার।’’