গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর-কাণ্ডের পর রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। জুনিয়র-সিনিয়র ডাক্তারদের একটি বড় অংশ চেপে ধরেছিলেন সরকারকে। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নাগরিক আন্দোলন। যা রাজনৈতিক ভাবে ‘চাপ’ তৈরি করেছিল শাসকদল তৃণমূলের উপরেও। মেদিনীপুরে মেডিক্যাল কলেজে এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা এবং পাঁচ জনের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরে আবার যখন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে, তখন প্রশাসন এবং তৃণমূল একযোগে চিকিৎসকদের ‘গাফিলতি’কে গোটা ঘটনার জন্য দায়ী করছে।
সোমবারেই সেই ইঙ্গিত মিলেছিল মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের কথায়। মঙ্গলবার ‘গাফিলতি’কে প্রতিষ্ঠিত করতে ময়দানে নামলেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ।
গত শুক্রবার এক প্রসূতির মৃত্যুর পরেই তাঁকে দেওয়া রিঙ্গার্স ল্যাকটেট স্যালাইনের (আরএল) গুণমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার পরেই স্বাস্থ্য দফতর তদন্ত কমিটি গঠন করে। কার বা কাদের গাফিলতিতে ওই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, আদৌ আরএল স্যালাইনের ব্যবহার তার জন্য দায়ী কি না ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখতে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে বেশ কিছু ওযুধ এবং স্যালাইনের নমুনা সংগ্রহ করে। কথা বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। পাশাপাশি, মেদিনীপুর মেডিক্যালের অধ্যক্ষ মৌসুমী নন্দী এবং স্ত্রীরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে এসএসকেএম হাসপাতালে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত কমিটি।
স্যালাইন-কাণ্ডে মুখ্যসচিব সোমবার বলেছিলেন, ‘‘আমরা কোনও গাফিলতি বরদাস্ত করব না। পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বিস্তারিত তদন্তের কথা বলেছি। সেই তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’’ প্রাথমিক রিপোর্টে কী আছে? মুখ্যসচিব জানান, নিয়ম অনুযায়ী, অস্ত্রোপচার হলে সব সময় এক জন সিনিয়র চিকিৎসকের উপস্থিতিতে জুনিয়র ডাক্তারেরা সেই কাজ করেন। কিন্তু মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতিদের চিকিৎসার সময় সেই ‘নিয়ম’ মানা হয়নি। তবে আরও তদন্ত দরকার। সেই তদন্তের কাজ চলছে। মুখ্যসচিব আরও বলেছিলেন, ‘‘আমরা মনে করি, এটা কোনও ভাবেই প্রোটোকল মেনে হয়নি।’’ অর্থাৎ, চিকিৎসকদের তরফে যে ‘প্রোটোকল’ মানা হয়নি এবং তাঁদের তরফে ‘গাফিলতি’ ছিল, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। মুখ্যসচিব বলেছিলেন, ‘‘স্যালাইনের পাশাপাশিই নিয়ম মেনে অক্সিটসিন দেওয়া হয়েছিল কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’
সেই সূত্রেই মুখ্যসচিবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রসূতির মৃত্যু কী কারণে হয়েছে? স্যালাইন না কি গাফিলতি? মুখ্যসচিব সেই প্রসঙ্গে স্পষ্ট জবাব দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সেটাই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’
তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মুখ খুলেছেন কুণাল। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিভ্রান্তি আর নজর ঘোরানোর খেলা বরদাস্ত করবেন না। বাস্তবটা জানুন।’’ এর পর ‘বাস্তব’ জানাতে মোট ছ’টি তথ্য দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। ১. যে সিনিয়র চিকিৎসকদের অস্ত্রোপচারের সময়ে থাকার কথা ছিল, তাঁরা কেউ ছিলেন না। ২. ছিলেন না কোনও অ্যানাস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞও। এক জন শিক্ষানবিশ ডাক্তারি পড়ুয়া অ্যানাস্থেশিয়া করেছিলেন। ৩. অস্ত্রোপচার করেছিলেন তৃতীয় বর্ষের দুই পিজিটি। সঙ্গে ছিলেন এক জন ইন্টার্ন। ৪. কাঁচা হাতে অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়ার সময় থেকেই সমস্যা শুরু। পরে সামলাতে গিয়ে জটিলতা বাড়ে। বেগতিক দেখে তাঁর সিনিয়রকে খবর পাঠানো হয়। ৫. ধামাচাপা দেওয়ার তাড়াহুড়োয় একই সময়ে একই ডাক্তার পাশাপাশি দু’টি টেবিলে দু’টি ওটি দেখিয়ে ফেলেছেন রেকর্ডে। ৬. প্রসূতি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, চিকিৎসকেরা তাঁর টিকিটে (হাসপাতালের কাগজ) বিস্তারিত রেকর্ড করেননি।
কুণালের বক্তব্য, ‘‘গোটা কেলেঙ্কারি চাপতে স্যালাইন ও অন্যান্য দিকে নজর ঘুরিয়ে সরকার-বিরোধী প্রচার করা হচ্ছে। স্যালাইনে কোনও ত্রুটি থাকলে প্রমাণিত হোক। কিন্তু তা দিয়ে যেন আসল কাণ্ড আড়াল না করা হয়।’’ মুখ্যসচিব যেমন সরকারের ‘মুখ’, কুণাল তেমনই শাসকদলের ‘মুখপাত্র’। একযোগে দু’জনের একই ধরনের কথায় অনেকে ‘নির্দিষ্ট নকশা’ও দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পরে এই ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের ‘কাঠগড়া’য় তোলার এই প্রচেষ্টার মধ্যে কোথাও একটা ‘যোগসূত্র’ রয়েছে। সেই পর্বে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ ‘চাপ’ তৈরি করেছিল সরকারের উপর। এ বার সেই ‘চাপ’ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।