Ritabrata Banerjee

তৃতীয় পরিচয়ে দ্বিতীয় বার রাজ্যসভায় ঋতব্রত, ‘কথা কম-কাজ বেশি’ কৌশলে ‘জহর’ চিনে নিলেন মমতা

২০১৪ সালে ঋতব্রতকে প্রথম রাজ্যসভায় পাঠায় সিপিএম। যে সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বুদ্ধদেবের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন ঋতব্রত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৮
Share:

ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

ব্যবধান এক দশকের। তার মধ্যেই দ্বিতীয় বার রাজ্যসভায় যাচ্ছেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তৃতীয় পরিচয়ে। একই রাজনীতিক তিনটি পরিচয়ে রাজ্যসভার সাংসদ— সাম্প্রতিক অতীতে দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে এমন ঘটনা কবে ঘটেছে, তা অনেকেই মনে করে বলতে পারছেন না।

Advertisement

২০১৪ সালে ঋতব্রতকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল সিপিএম। অধুনাপ্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তীর আসনে ওই তরুণ নেতাকে সংসদের উচ্চকক্ষে পাঠিয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কিন্তু প্রথম মেয়াদের মাঝেই ২০১৭ সালে সিপিএম বহিষ্কার করে ঋতব্রতকে। তার পর রাজ্যসভায় দ্বিতীয় পরিচয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই বাগ্মী নেতার। ‘দলহীন সাংসদ’। ২০২০ সালে রাজ্যসভায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন একদা এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত। জহর সরকারের ইস্তফার কারণে শূন্য আসনে ঋতব্রতকেই ‘জহর’ বলে মনে করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার তৃতীয় পরিচয়ে রাজ্যসভায় যাচ্ছেন তিনি। সিপিএম, দলহীনের পর তৃণমূল।

তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে ঋতব্রতের হিতৈষীরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি ভাল বক্তা হতে পারেন, কিন্তু মমতার দলে তাঁকে কথা কম বলে কাজটা বেশি করে করতে হবে। ঋতব্রত তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন। সেই ‘কৌশলেই’ মমতার নজর কেড়েছেন ৪৫ বছর বয়সি এই নেতা। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ এবং প্রায় সমবয়সি সতীর্থের কথায়, ‘‘নিজের সুবক্তা পরিচয়ের অতীত পিছনে ফেলে মাথা নিচু করে দলের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে ঋতব্রত। নিজের কথা কোথাও বলতে যায়নি। সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে।’’ এই হিতৈষীরা মনে করেন, আপাতত ঋতব্রতের কাজ একটাই— যে ১৫ মাস (জহরের মেয়াদের ওই সময়ই এখন বাকি) তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে পাবেন, তার ‘পূর্ণ সদ্ব্যবহার’ করে এই মেয়াদের শেষে আবার পূর্ণ মেয়াদে রাজ্যসভায় মনোনয়ন পাওয়া।

Advertisement

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে তৃণমূলে যে সাংগঠনিক রদবদল হয়েছিল, তাতে অন্যতম ‘চমক’ ছিলেন ঋতব্রত। তাঁকে শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির সভাপতি করেছিলেন মমতা। তার পর থেকে চুপচাপ কাজ করে গিয়েছেন তিনি। দায়িত্ব পাওয়ার পর ঋতব্রত বলেছিলেন, তিনি সব ক’টি ‘ট্রেডে’ তৃণমূলের ইউনিয়ন তৈরি করতে চান। গত সাড়ে তিন বছরে সেই কাজে তিনি অনেকটাই এগোতে পেরেছেন। অন্তত তেমনই মনে করেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকে। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান এলাকায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছেন। সে কারণেই রাজ্যসভায় ঋতব্রতের মনোনয়ন সম্পর্কে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে বলা হচ্ছে, ‘‘কঠোর পরিশ্রম করলে ফল মিলবেই।’’

দ্বিতীয়ত, তাঁর আমলে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলে গিয়েছে। একটা সময়ে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের অন্দরে নেতাদের দ্বন্দ্ব ছিল বঙ্গ রাজনীতির রুটিন ঘটনা। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্ব, তার পরে শোভনদেবের সঙ্গে দোলা সেনের কোন্দল সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঋতব্রত সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত সাড়ে তিন বছরে তেমন কিছু দেখা যায়নি আইএনটিটিইউসিতে। প্রতি দিন নিয়ম করে দফতরে বসেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক ইউনিয়নের দাবিদাওয়া মেটাতে উদ্যোগী হয়েছেন। নিয়মিত নব মহাকরণে লেবার কমিশনের দফতরে গিয়ে সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন। মজুরি বৃদ্ধি, বোনাস, পিএফ-সহ শ্রমিক সংগঠনের বনিয়াদি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করার মতো কাজ করেছেন। কিন্তু নীরবে। সপ্তাহ দেড়েক আগে তৃণমূলের তরফে টেলিভিশন চ্যানেলে দলের তরফে যাঁরা যাবেন, তাঁদের তালিকায় নাম ছিল ঋতব্রতের। খানিকটা ইঙ্গিত তখনই পাওয়া গিয়েছিল। শনিবার তাঁর রাজ্যসভায় মনোনয়ন তাই দলের অন্দরে সকলকে অবাক করেনি।

সংগঠনে গোষ্ঠীলড়াই যেমন হতে দেননি, তেমনই ঋতব্রত যুগপৎ সমর্থন পেয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কারণ, ঋতব্রত যখন দলের শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন, তখনও মমতা বিভিন্ন শাখা সংগঠনের দায়িত্ব অভিষেকের হাতে দিয়ে রেখেছিলেন। তৃণমূলের অন্দরের সমীকরণ যাঁরা জানেন, তাঁরা বোঝেন, দলের দুই স্তম্ভের ‘আস্থাভাজন’ হওয়া নেহাত ‘ছেলেখেলা’ নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ঋতব্রতের রাজ্যসভায় মনোনয়নের পর সমাজমাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আইপ্যাকের কর্তা প্রতীক জৈন। ঋতব্রতকে ‘দাদা’ সম্বোধন করে তিনি লিখেছেন, ‘‘কঠোর পরিশ্রম যে ফল দেয়, আপনি তার ধ্রুপদী উদাহরণ। শুধু ধৈর্য ধরে ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।’’ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, রাজ্যের এই ‘পরামর্শদাতা’ সংস্থার তরফে কোনও ব্যক্তি বিশেষকে এই ভাবে প্রকাশ্যে অভিনন্দন জানানোর নজির আর নেই। বিশেষত, সেই সময়ে যখন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সম্পর্কে খুব ‘সদয়’ মন্তব্য করছেন না। তবে তৃণমূলের সকলেই জানেন, ঋতব্রত আইপ্যাকের সঙ্গে বরাবর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে কাজ করেছেন। সেই কারণে তাঁরা প্রতীকের প্রকাশ্য অভিনন্দন-বার্তাকে স্বাভাবিকই মনে করছেন।

সিপিএমে থাকার সময়েই ঋতব্রত সাংগঠনিক স্তরে দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। আশুতোষ কলেজের এসএফআইয়ের ইউনিট কমিটির সম্পাদক থেকে সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। দু’বার সেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ছাত্রনেতা থাকার সময়েই সিপিএমের রাজ্য কমিটিরও সদস্য হন। ২০১৪ সালে তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠায় সিপিএম। যে সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বুদ্ধদেবের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন ঋতব্রত। রাজনীতি ছাড়াও রবীন্দ্রসাহিত্য, দেবব্রত বিশ্বাসের গানের প্রতি ‘আসক্তি’ বুদ্ধদেবের নজর কাড়ার কারণ ছিল বলে অভিমত সিপিএমের অনেকের। প্রয়াত সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন ঋতব্রত।

যদিও তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো নিয়ে সিপিএমে মতানৈক্য ছিল। রেজ্জাক মোল্লার মতো নেতারা ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। কিন্তু বুদ্ধদেবের কারণেই রেজ্জাকেরা সফল হননি। তখন ঋতব্রতের পক্ষে ছিলেন গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তীর মতো নেতারাও। কারণ একটাই, ঋতব্রত ‘সুবক্তা’। সর্বভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা ‘স্বচ্ছ’। ২০১৭ সালে বিভিন্ন অভিযোগে বিদ্ধ ঋতব্রতকে সেই সিপিএমই বহিষ্কার করে। তাঁকে শাস্তি দেওয়ার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মহম্মদ সেলিম। ঘটনাচক্রে, ঋতব্রত যখন তৃণমূল সাংসদ হিসাবে রাজ্যসভায় যাবেন, তখন সেলিমই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বে।

তৃণমূল সূত্রের খবর, ঋতব্রতকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে দলের মধ্যে কোনও মতানৈক্য ছিল না। সব শিবিরের মুখে একটাই কথা, ‘‘পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন।’’ খেলাধুলা সম্পর্কেও আগ্রহ রয়েছে এই তৃণমূল নেতার। রাজ্যসভার সাংসদ থাকার সময়ে কলকাতা ময়দানের ক্লাবগুলির উন্নতি নিয়ে সংসদে সরব হয়েছিলেন তিনি। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি— তিনটি ভাষাতেই সাবলীল বক্তৃতা করতে পারেন ঋতব্রত। হাতের লেখা ঝকঝকে হওয়ায় সংসদে প্রশ্ন জমা দিতেন হাতে লিখেই। যাতে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ঋতব্রতকে একটি মহার্ঘ ফরাসি কলম (ম ব্লাঁ) উপহার দিয়েছিলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement