—প্রতীকী ছবি।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন হিংসার বলি হয়েছিলেন যে ১৮ জন, তার অর্ধেক জায়গায় সোমবার পুনর্নির্বাচনই হল না। বাকি অর্ধেকে ভোট শান্তিপূর্ণ।
নির্বাচন কমিশন সূত্রের ব্যাখ্যা, যেখানে যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে, সেই সব এলাকায় পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথায় অশান্তি হয়েছে বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিজন বা গ্রামবাসী এই ‘যুক্তি’ মানতে নারাজ।
মুর্শিদাবাদে ভোটের দিন খুন হন চার জন। এর মধ্যে লালগোলায় সিপিএম কর্মী রওশন আলি যে বুথে খুন হন, শুধু সেখানেই পুনর্নির্বাচন হয়েছে। ভোটের দিন জখম এক জন রবিবার সন্ধ্যায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালে, আর এক জন ওই রাতেই কলকাতার হাসপাতালে মারা যান। ওই দুই জায়গাতেও সোমবার ভোট হয়নি। সে দিন নওদার গঙ্গাধারী গ্রামে বোমায় নিহত কংগ্রেস কর্মী হাজি নিয়াকত আলির ভাইপো মাসিদুল শেখ জেলা পরিষদের ৭৪ নম্বর আসনের কংগ্রেস প্রার্থী। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘ওই খুনের পর আমাদের ভোটাররা বুথে যেতে পারেননি। পুনর্নির্বাচনের দাবি জানাই। কিন্তু প্রশাসন কানে তুলল না।’’ মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
ভোটের দিন উত্তর দিনাজপুরেও নিহতের সংখ্যা চার। চার জায়গাতেই এ দিন ফের ভোট হয়েছে। গোয়ালপোখর-২ ব্লকে খুন হন গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ শাহেনশা। সোমবার ওই বুথে ফের ভোট হয় পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের আসনে। প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে ভোট হয়নি। শাহেনশার স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘‘কার জন্য, কিসের জন্য ভোট দেব?’’ সাহাপুরের নয়ারহাট বুথে তৃণমূল কর্মী শামসুল আলম ও কংগ্রেস কর্মী জমিরউদ্দিন খুন হয়েছিলেন। দুই বুথেই ফের ভোট হয়েছে। শামসুলের স্ত্রী-পরিবার ভোট দিলেও ভোট দেননি জমিরউদ্দিনের পরিবার। হেমতাবাদ পঞ্চায়েতের দু’টি বুথে ফের ভোট নেওয়া হলেও গিয়াসিলের বাসিন্দা মৃত নারায়ণ সরকারের মেয়ে তুলসী সরকার বলেন, “ভোট নিয়ে আমাদের কোনও উৎসাহ নেই।”
ভোটের দিন কোচবিহারে মৃত্যু হয়েছিল তিন জনের। এর মধ্যে দুই জায়গায় ফের ভোট হয়। ফলিমারিতে বোমায় বিজেপির পোলিং এজেন্ট মাধব বিশ্বাস এবং দিনহাটার ভাগ্নীতে বুথের ভিতর গুলিবিদ্ধ হন চিরঞ্জিত কার্জি। মাধবের বাবা ও স্ত্রী ভোট না দিলেও ভাই রতন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘ভোটের মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানালাম।’’ চিরঞ্জিতের পিসি মাধবী কার্জিও বলেন, ‘‘চিরঞ্জিতের বাবা, মা ও দাদার ভোট দিতে যাওয়ার অবস্থা ছিল না।’’ শুক্রবার রাতে তুফানগঞ্জ-২ ব্লকে ছাটভলকার বুথে তৃণমূল চেয়ারম্যান গণেশ সরকারকে খুনের অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। প্রশাসনের দাবি, শনিবার ওই এলাকায় কড়া নিরাপত্তায় ভোট হয়েছে। ফলে এ দিন আর ভোটের প্রশ্ন ছিল না।
পূর্ব বর্ধমানে নিহত হয়েছিলেন দু’জন। কোনও বুথেই ফের ভোট হয়নি। কাটোয়ার নন্দীগ্রামে তৃণমূল কর্মী গৌতম রায়কে খুনের অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। কোনও দলই পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায়নি। ভোটের আগের দিন আউশগ্রামের বিষ্ণুপুর গ্রামে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষে জখম হন সিপিএম কর্মী রাজিবুল হক। পর দিন মৃত্যু হয়। ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী শেখ মহম্মদ আজহারউদ্দিন বলেন, ‘‘ভোটের দিন সমস্যা হয়নি। তাই পুনর্নির্বাচন চাইনি।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মারা যান দু’জন। দুই জায়গাতেই ফের ভোট হয়েছে। বাসন্তীর ফুলমালঞ্চ গ্রাম পঞ্চায়েতে বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় তৃণমূল সমর্থক আনিসুর ওস্তাগরের। এ দিন আনিসুরের বাবা, মা ও স্ত্রী ভোট দেন। স্ত্রী রোজিনা বলেন, “সে দিন যদি এ রকম নিরাপত্তা থাকত, ওকে মরতে হত না।” কুলতলির জালাবেড়িয়া-২ পঞ্চায়েতের পশ্চিম গাবতলায় মারা গিয়েছিলেন তৃণমূল কর্মী আবু সালাম খান। ছেলে হজরত বলেন, “সক্রিয় রাজনীতি আর করতে পারব না।”
ভোটের দিন সকালেই নদিয়ার চাপড়ায় ১৪৮ নম্বর বুথের সামনে খুন হয়েছিলেন তৃণমূল কর্মী হামজার আলি হালসানা। সেই বুথে আর ভোট নেওয়া হয়নি। গ্রামবাসীদের আক্ষেপ, খুনের পর বিরোধী ভোটারেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে প্রচুর ছাপ্পা পড়েছে। নিহতের স্ত্রী সেরিফা হালসানা বলেন, “আবার ভোট না হয়ে ভালই হয়েছে। আবার হয়তো কেউ মারা যেত।”
এনআরএস হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকলে গুলিবিদ্ধ নয়ন মণ্ডল। এ দিন মধুরকুল হাইস্কুলের বুথে ভোট দিয়ে বেরিয়ে তাঁর মা প্রণতি পাল মণ্ডল বলেন, ‘‘বুলেটের জবাব ব্যালটেই দিয়ে গেলাম।’’
যেখানে মৃত্যু হয়েছে, তেমন সব জায়গায় পুনর্নির্বাচন না হওয়ায় বিরোধীরা সরব। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘‘যে বুথগুলিতে পুনর্নির্বাচন হচ্ছে, তার তালিকা আইপ্যাকের তৈরি।... ক্যামাক স্ট্রিট থেকে কমিশনে সেই তালিকা এসেছে।’’ তাঁর দাবি, আদালতে গিয়ে ফের পুনর্নির্বাচন চাইবেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমেরও বক্তব্য, ‘‘কমিশনের কাছে বুথ ধরে তালিকা দিয়েছিলাম। তেমন কোনও বুথে পুনর্নির্বাচন হয়নি। সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখা হল না কেন?’’
রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘এমন অনেক জায়গায় পুনর্নির্বাচন হয়েছে, যেখানে আমরা চাইনি। আবার এমন জায়গায় হয়নি— যেখানে আমরা পুনর্নির্বাচন চেয়েছিলাম।’’