অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
৫১ দিনের যাত্রা। সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথচলা। ১৩৫টি জনসভা, ৬০টি বিশেষ অনুষ্ঠান, ১২৫টি রোড শো, ৩৩টি রাতের অধিবেশন।
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মসূচি শেষে এমনই তথ্য দিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ যাত্রা শুধু শুকনো তথ্যের ওজন দেখানোর জন্য অভিষেক করতে নামেননি। বরং তৃণমূল বা বিরোধী সব পক্ষই এই কর্মসূচির দিকে নজর রেখেছে একটা জিনিসই দেখতে, কাজের কাজ কতটা হল? এই হিসাব এখনই কষা যাবে না। প্রাথমিক প্রভাবটা বোঝা যাবে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে। তার পর আসবে লোকসভা নির্বাচনও। কিন্তু অভিষেকের রাজনৈতিক যাত্রায় আরও অনেক দীর্ঘমেয়াদি পথ চলাতেই এই ‘যাত্রা’র বিচার হতে থাকবে।
যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৫ এপ্রিল। শুরু হয় উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে। শুরুর আগে থেকেই বিরোধীরা কখনও খোঁচা দিয়ে, কখনও অবজ্ঞার সুরে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। সব শুনে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘এমন কর্মসূচি কেউ আগে কখনও করেনি। কেউ এমন কর্মসূচি করুক, তার পরে বাকি কথা শোনা যাবে।’’ শুক্রবার, ১৬ জুন কর্মসূচি শেষ হল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপে। ৫১ দিনের কর্মসূচি শেষে অভিষেক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘দলনেত্রীর অনুপ্রেরণায় মানবসেবার ব্রত নিয়ে পথে নেমেছিলাম। সেই পরিক্রমার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে একইসঙ্গে গণদেবতার আস্থা এবং দলনেত্রীর আশিস অর্জন করেছি আমি! আমার হৃদয়ের পদ্মাসনে গণদেবতা চির আসীন। কথা দিচ্ছি, বাংলা জুড়ে উন্নয়নে নবজোয়ার আনবই! আমার এই রাজ্য গোটা দেশে একদিন প্রাগ্রসরের ভূমিকা পালন করবে— এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।’’
এই কর্মসূচিকে স্বাভাবিক ভাবেই বড় সাফল্যের নিরিখেই দেখছে তৃণমূল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার কাকদ্বীপের সভায় ছিলেন। সেখানে দেখা যায় মঞ্চে মমতার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন অভিষেক। বিজেপি বারবারই অভিষেককে নিয়ে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলে। সেই প্রসঙ্গে টেনেই মমতা শুক্রবার একটি পুরনো ছবি তুলে ধরে জানান, অভিষেক মাত্র দু’বছর বয়স থেকে রাজনীতি করছেন। মমতার হাতের ছবিতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছেন শিশু অভিষেক। ওই ছবি দেখিয়ে মমতা বলেন, ‘‘ ১৯৯০ সালে সিপিএম যখন আমাকে মেরে চৌচির করে দিয়েছিল, আমি বাড়ি ফিরে এসেছি, অভিষেকের তখন ২ বছর বয়স। মার কোলে বসে সব ঘটনা শুনেছে। তার পর দিন থেকে একটা ঝান্ডা নিয়ে বলত, দিদিকে মারলে কেন সিপিএম জবাব দাও।’’
শৈশবে রাজনীতি করা বা করানো নিয়ে তর্কের অবকাশ যথেষ্ট। কিন্তু সব রাজনীতিবিদদেরই একটা রাজনৈতিক শৈশব থাকে। আর সব জীবনের মতোই এখানেও ক্রমশ পরিণত হওয়ার, আরও পরিণত হওয়ার চর্চা। অবিরাম চর্চা। এরই মধ্যে বিশেষ বিশেষ ঘটনা, বিশেষ বিশেষ সন্ধিক্ষণ এই পরিণতিবোধকে এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। অভিষেকের ক্ষেত্রে এই দীর্ঘ যাত্রা, গ্রামের পর গ্রাম চষে ফেলা কি তেমন কিছু ঘটাল?
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘এটা দেশের মধ্যে বিরলতম জনসংযোগ।’’ তাঁর মতে, এই কর্মসূচির মাধ্যমে তিনটি কাজ হয়েছে, ‘‘প্রথমত, কর্মীদের রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প সম্পর্কে তিনি সচেতন করেছেন। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারের এবং রাজ্য-বিরোধীদের চক্রান্তের নমুনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তৃতীয়ত, সাংগঠনিক শক্তিকে চাঙ্গা করেছেন।’’ তৃতীয় বিষয়টা নিয়ে কুণালের বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে গোটা দলকে রাস্তায় নামিয়েছেন অভিষেক। সংগঠনকে গতিশীল করেছেন। আর ক্ষমতাজনিত যে মেদ জমেছিল তা-ও চিহ্নিত হয়েছে। মেদ ঝড়ানোও হয়েছে।’’
এ তো গেল সংগঠনের দিক। অভিষেকের নিজের রাজনৈতিক চরিত্রে এর প্রভাব কি তেমন ভাবে পড়বে? তৃণমূলের অনেক পোড় খাওয়া নেতাই মনে করছেন, পড়বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক প্রবীণ বললেন, ‘‘ অভিষেক কখনওই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মাটিতে নেমে রাজনীতি করেননি। তাঁর উত্থান মমতার ক্ষমতাসীন সময়েই। এই বিরাট যাত্রাপথ, নীচতলার মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ওঁকে বিরাট অভিজ্ঞতা দিল নিঃসন্দেহে।’’
অভিষেক নিজে কী বলছেন? কাকদ্বীপের সভায় তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘‘পঁচিশে এপ্রিলের আগের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আজ ষোলই জুনের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে অনেক ফারাক। পথে পথে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মিশে আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে গিয়েছে। অনেক কিছু শিখলাম, জানলাম।’’ এর পর তাঁর সংযোজন, ‘‘ গুরুজনদের কাছে শুনতাম, প্রকৃতি সর্বশক্তিমান। আজ আমার উপলব্ধি, পৃথিবীতে সর্বশক্তিমান মানুষই।’’
বিরোধীরা অবশ্য এখনও এই জনসংযোগ যাত্রাকে কোনও রকম গুরুত্ব দিতে নারাজ। মন্তব্য করতে গিয়ে মমতার বলা প্রসঙ্গই টেনেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ করে দু’বছর বয়স থেকে রাজনীতি করছেন বলার দরকার পড়ল কেন? গত এক দশকের কথা বলছেন না কেন?’’ সেলিমের সংযোজন, ‘‘মমতা ফ্ল্যাশ ব্যাকে গেলেন কারণ, গত দু’মাসে যত খরচ হয়েছে তার কোনও ফল নেই। সাত মন তেল পুড়লেও রাধা নাচল না। এটাকে বলে, রাত ভর আন্ডা পাকায়া, ফিরভি কাচ্চা রয়ে গ্যায়া।’’
বিজেপির সুরও আক্রমণাত্মক। দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘মানুষের পুঞ্জিভূত জনরোষ, দলীয় গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব মেটাতেই এই যাত্রা ছিল। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক লুঠ থেকে মানুষ এবং সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি ঘোরানোর এটি একটি দুর্বল চিত্রনাট্য। আংশিক জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে হাজার হাজার পুলিশ ব্যবহার করে বাংলার তো কোনও লাভ হয়নি। তৃণমূলেরও হবে কি না জানি না। মানুষের অধিকারের কথা বলে মানুষের উপরেই দখলদারি চাপিয়ে দেওয়া দেখল বাংলা।’’
অভিষেকের এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা নিজে। তিনি যে এই যাত্রাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তা একাধিক বারই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার কাকদ্বীপে তো বটেই, তার আগে মালদহ এবং শালবনিতে অভিষেকের মঞ্চে হাজির ছিলেন তিনি। বাঁকুড়ার ইন্দাসে কর্মসূচির মাঝেই যখন সিবিআইয়ের তলবে কলকাতায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন অভিষেক, তখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে বক্তব্য রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গোটা কর্মসূচির দিকে নিঃসন্দেহেই প্রতিনিয়ত সজাগ নজর ছিল তাঁর। ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা এমনটাও বলেছেন যে, এই কর্মসূচিটা অভিষেক এবং দল দুইয়ের পক্ষেই জরুরি ছিল। ভালও হয়েছে। এত দীর্ঘ দিনের কর্মসূচি নিতে তিনি যে অভিষেককে নিষেধ করেছিলেন তা-ও জানিয়েছিলেন মমতা। অভিষেক নাকি জেদ করেই এ ভাবে কর্মসূচি করার অনুমতি নেন।
তৃণমূলের একটা অংশ মনে করছেন, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার থেকেও বেশি ছাপ ফেলেছে ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচি। কারণ, এক টানা শরীর ও মনে চাপ নিয়ে কর্মসূচি চালিয়েছেন অভিষেক। কখনও প্রার্থী বাছাই নিয়ে দলের ভিতরের গোলমাল প্রকাশ্যে এসেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা দেখা গিয়েছে। কখনও কালবৈশাখীর ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে সভাস্থল। কখনও আবার কনভয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর উপরে ছিল সিবিআই এবং ইডির তলব। তার পরেও সূচি মেনে কর্মসূচি সফল করাকে ‘ক্যাপ্টেন’স ইনিংস’ বলেই মনে করছেন তাঁরা। দাবি করা হচ্ছে, এর পরে গোটা দলই ভাল খেলবে।
আর অভিষেক ফেসবুকে কর্মসূচির শেষ দিনে লিখেছেন, ‘‘সমুখে শান্তিপারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’’ তরণী কোন স্রোতে বইবে তা জানার অপেক্ষা আপাতত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল জানা পর্যন্ত। তার পরও তাঁর যাত্রাপথের দিকে নানা ভাবে, নানা দিক থেকে নজর রাখবেন অনেকেই।
(এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় অভিষেক তাঁর জনসংযোগ যাত্রায় ৪৫ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন বলে লেখা হয়েছিল, যা ঠিক নয়। তাঁর যাত্রাপথ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটারের। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।)