হাসানুজের দেহের পাশে পড়ে রয়েছে পিস্তল। নিজস্ব চিত্র।
ঘড়িতে বেলা সওয়া দু’টো। আটপৌরে বাড়িটিতে মা-মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আচমকাই দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন এক যুবক। বাড়ির বাসিন্দা বছর আঠাশের যুবতী তখন বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছেন। মা ব্যস্ত রান্নাঘরে। এরপর পকেট থেকে পিস্তল বের করে সটান যুবতীর দিকে তাক করেন ওই যুবক। প্রাণে বাঁচতে বাথরুমে ঢুকে দরজা দেন যুবতী। তারপর কানফাটা গুলির শব্দ। বাইরে বেরিয়ে যুবতী দেখেন, কুয়োর পাশে মেঝেতে পড়ে রয়েছে যুবকের রক্তাক্ত দেহ। পাশে পড়ে পিস্তল।
রবিবার দুপুরে সেলুলয়েডের গল্পকেও হার মানানো এই ঘটনার সাক্ষী রইল মেদিনীপুর পুর-এলাকার একটি পাড়া। পুলিশ সূত্রে খবর, আত্মঘাতী যুবকের নাম চৌধুরী হাসানুজ ওরফে খোকন (৩০)। বাড়ি বীরভূমের বোলপুরের সনসত গ্রামের মোল্লাপাড়ায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, প্রেমে প্রত্যাখাত হয়েই ওই যুবক মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। মৃতের ব্যাগ ও ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা পিস্তল বাজেয়াপ্ত করেছে মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানার পুলিশ। এ দিন ঘটনাস্থলে এসেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) শচীন মক্কর। তিনি বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
ওই যুবতী অবশ্য এ দিন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তাঁর এক পরিজন বলেন, “ওর মানসিক অবস্থা ঠিক নেই। বাড়ির মধ্যে চোখের সামনে এমন ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।” জানা গিয়েছে, যুবতী জেলারই এক আদালতের কর্মী। কয়েক বছর আগে তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন। মায়ের সঙ্গেই থাকেন তিনি। তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে জেনেছেন, বছর খানেক আগে ফেসবুকের মাধ্যমে হাসানুজের সঙ্গে যুবতীর আলাপ হয়। তারপর মোবাইল নম্বর, এমনকী বাড়ির ঠিকানা দেওয়া-নেওয়াও হয়।
কিন্তু কেন এমন কাণ্ড ঘটালেন হাসানুজ? প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, মাস খানেক হল দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছিল। ওই যুবতী আর হাসানুজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইছিলেন না। যুবতী পুলিশকে জানিয়েছেন, হাসানুজ তাঁর কাছে অনেক কথা গোপন করেছিলেন। তাই তিনি সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু নাছোড় হাসানুজ সোজা মেদিনীপুরে চলে আসেন।
আরও পড়ুন:
কর দিক কাজ-খেকো রোবট, চান বিল গেটস
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, শনিবারও যুবতীর বাড়িতে এসেছিলেন হাসানুজ। যুবতী তখন বাড়িতে ছিলেন না। ক্যুরিয়ার সংস্থার কর্মী পরিচয় দিয়ে যুবতীর মা-র কাছে একটি খাম রেখে যান তিনি। পরে খাম খুলে দেখা যায়, ভেতরে যুবতীকে লেখা চিঠি, সঙ্গে একটি চেকও রয়েছে। ওই চিঠিতে হাসানুজ ঠিক কী লিখেছিলেন, চেক-ই বা কেন দিয়েছেন, সব খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
হাসানুজের বাবা চৌধুরী জাকির হোসেন পেশায় কৃষক। এ দিন ঘটনা শোনার পরে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ে তাঁর বাড়ির উঠোনে। হাসানুজের বোন শ্রাবণী বলেন, ‘‘ছোট মামার ল্যাপটপ কিনতে শুক্রবার দাদা কলকাতা গিয়েছিল। তারপর একবার ফোনে কথা হয়েছিল। কিন্তু এ দিন দুপুরে চেষ্টা করেও দাদাকে ফোনে পাইনি।’’ পরে মামা জানিয়েছিলেন, শিয়ালদহের কাছে যে হস্টেলে হাসানুজ থাকতেন, সেখান থেকে সকাল আটটা নাগাদ বেরিয়ে যান। আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যায় পুলিশের মাধ্যমে হাসানুজের মৃত্যুসংবাদ বাড়িতে পৌঁছয়।
হাসানুজের মা হাসনাবানু বলছিলেন, ‘‘ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর হয়ে ছেলে বিএড-এ ভর্তি হয়েছিল। কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।’’ নির্বিবাদী ছেলেটার এমন পরিণতিতে গ্রামবাসীও হতভম্ব। স্থানীয় বাসিন্দা মহরম চৌধুরী, শেখ বাদশা, শেখ সাবু, মনিরা বিবিরা বলেন, ‘‘খুব ভদ্র ব্যবহার ছিল খোকনের। পড়াশোনাতেও ভাল ছিল। ও এমন কাণ্ড ঘটাবে ভাবিনি।’’