প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
পুজোতে মণ্ডপে নয়, আবার মাতঙ্গিনী মূর্তির পাদদেশে ধর্না মঞ্চেও নয়। পেটের দায়ে বাড়ি থেকে এ বার বহু দূরে পাড়ি দিলেন ওঁরা কয়েক জন। ওঁদের নাম আদতে যা-ই হোক না, এত দিন পরিচয় ছিল রাজ্যের শিক্ষক পদপ্রার্থী হিসাবে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিয়োগের দাবিতে ধর্না দিয়ে শুধু বয়স বেড়ে গিয়েছে। চাকরি জোটেনি। ভবিষ্যৎও ক্রমশ আঁধারে ডুবতে বসেছে। তাই বাড়ি, গ্রাম, রাজ্য ফেলে পেটের দায়ে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। যাতে সরকারি স্কুলের শিক্ষক পদ না জুটুক, অন্তত পেটের সংস্থানটুকু হয়। কেউ কেউ আবার ভিন্ রাজ্যে যাননি। তবে বাড়ি ছেড়ে রাজ্যের ভিতরেই অন্যত্র ছোটখাটো কাজ খুঁজে নিয়েছেন।
নদিয়ার কল্যাণীর এক বাসিন্দা দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষক পদের জন্য আন্দোলন করছিলেন। পাড়ার পুজোতেও এক সময় সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু এ বার পুজোর আগে বেঙ্গালুরু পাড়ি দিয়েছেন। কাজের খোঁজে। ফোনে শুক্রবার বললেন, ‘‘এখন হয়তো পাড়ার পুজোয় বোধনের ঢাক বাজছে। কিন্তু এ বার পুজোয় বাড়ি থাকতে পারলাম না।’’ বেঙ্গালুরুতে আপাতত হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন। এক বন্ধুর সুবাদে আপাতত তাঁর বাড়িতেই ঠাঁই পেয়েছেন। কল্যাণীর ওই যুবক বলছেন, ‘‘কাজ নেই, হাতে টাকাও নেই। বাড়ি ফিরব কী ভাবে?’’ তার পরে একটু থেমে বললেন, ‘‘চাকরির আন্দোলন করতে করতে বয়স ৪৭ পেরিয়েছে। পুজোর সময় খালি হাতে বাড়ি ফেরা যায়? বলতে পারেন, বেকারত্বের লজ্জা এড়াতে বেঙ্গালুরুতে মুখ লুকিয়েছি।’’
চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে হুগলির প্রশান্ত পালের মতো কেউ কেউ রাজ্যের মধ্যেই ভিন্ জেলায় কাজ নিয়েছেন। তাঁদের অনেকে পুজোয় বাড়ি ফিরতে পারেননি। আসানসোলে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত প্রশান্ত বলছেন, ‘‘৩০ বছর বয়সে চাকরির আবেদন করেছিলাম। এখন বয়স ৪০ পেরিয়েছে। আন্দোলন করলাম, কিন্তু জগদ্দল পাথর তাতে নড়ল না।’’ এক সময় গ্রামে প্রাইভেট টিউশন করতেন। তাতে বাঁধা রোজগার নেই। প্রশান্ত বলেন, ‘‘সামান্য বেতনে একটা বেসরকারি সংস্থায় ডেটা এন্ট্রির কাজ করছি।’’ পুজোয় ছুটি মেলেনি। বলছেন, জোর করলে হয়তো দু’দিন ছুটি মিলত। কিন্তু বাড়ি আসার খরচও আছে। তাই আর বাড়ি ফেরেননি।
ধর্মতলায় মাতঙ্গিনী মূর্তির পাদদেশের মঞ্চে ৪০০ দিনেরও বেশি ধর্না অবস্থান চালাচ্ছেন ইন্টারভিউ বঞ্চিত উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁদের দাবি, গেজেটের নিয়ম মেনে শূন্য পদের তালিকা তৈরি করতে হবে অর্থাৎ সিট আপডেট করে চাকরি দিতে হবে। কিন্তু তা নিয়ে টালবাহানা চলছেই। গান্ধী মূর্তি ও মাতঙ্গিনী হাজরা মূর্তির কাছে চাকরি-প্রার্থীদের ধর্নামঞ্চে শুক্রবার গিয়েছিলেন সিপিএমের যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, কলতান দাশগুপ্তেরা। মীনাক্ষীর বক্তব্য, ‘‘শুধু চাকরিপ্রার্থীরা নন, গোটা রাজ্যের সমস্যা এটা। এই লড়াইয়ে আরও মানুষকে যুক্ত করার বার্তা নিয়ে আমরা ইনসাফ যাত্রা করব ৩ নভেম্বর থেকে। কোচবিহার থেকে শুরু হবে এই যাত্রা। তার পরে ব্রিগেডে জনসভা করব। আগামী ৭ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশে আপনাদেরও পাশে চাই।’’
প্রথম দিন থেকে ধর্না মঞ্চে বসে থাকা আজহার শেখ বলছেন, “এ ভাবে বছরের পর বছর সময় কাটিয়ে দিয়ে হয়তো আমাদের আন্দোলনকে ভেঙে দিতে চাইছে সরকার। অনেকেই তো হতাশ। কারণ, চাকরির বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই ধর্না, আন্দোলনকে সমর্থন করে পুজোর আগে কাজের খোঁজে অন্য জায়গায় পাড়ি দিয়েছে। আরও হয়তো অনেকেই চলে যাবে।” শেষ বাক্যে বেজে ওঠে হতাশার সুর। বোধনের ঢাক তা চাপা দিতে পারে না।