মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর চশমা নিয়ে বছর তিনেক আগে বেশ শোরগোল শুরু হয়েছিল। চশমার কাচে লেখা ‘স্বচ্ছ ভারত’। তার নীচে স্লোগান: স্বচ্ছতার দিকে এক কদম। এ নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের এক আধিকারিক। নয়াদিল্লি আবার তার পাল্টা জবাবও দেয়। ততদিনে অবশ্য চশমা দিয়ে প্রকল্প চেনানোর কাজটি সুসম্পন্ন।
একই চশমা দেশের ‘নোটেও’ বিদ্যমান। যদিও আদত চশমাটি সেবাগ্রাম আশ্রম থেকে ২০১১ সালে চুরি গিয়েছে। কেন? একটি চশমার এমনকি মূল্য? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ তথা অক্ষয়কুমার মৈত্র সংগ্রহশালার অধিকর্তা বিজয়কুমার সরকার বলেন, ‘‘একটি পুরনো সামগ্রী, বিশেষ করে চশমার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মূল্যের দু’টি দিক থাকে। প্রথমত, কোন সময়ে সেটি তৈরি। দ্বিতীয়ত, কে বা কারা সেটি ব্যবহার করতেন।’’ তাই গাঁধীর চশমা যে চুরি যাবে এর আর বেশি কী!
এনজেপি-তে কয়েক দিন আগে উদ্ধার হওয়া চশমারও কি তেমনই কোনও ইতিহাসিক মূল্য রয়েছে? এই প্রশ্ন এর মধ্যেই উঠতে শুরু করেছে। রটতে শুরু করেছে নানা কল্পকাহিনিও। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, উদ্ধার হওয়া চশমার পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ না হলে মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয়। এই ‘আবিষ্কারই’ নতুন করে ইন্ধন জুগিয়েছে চশমার আলোচনায়।
ঠিক কবে থেকে চশমার ব্যবহার শুরু হয়েছে? আদি শঙ্করাচার্যের লেখা ‘অপ্রতক্ষ অনুভূতি’তে চশমা ব্যবহারের উল্লেখ মেলে বলে দাবি করেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদেরা। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন অনুসারী তাঁর সেই ‘উপনেত্রের’ আখ্যানেই ছিল চশমা বিবরণ। তা ৫০৯-৪৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। তার পরেও ভারতে প্রাক মুঘল এবং মুঘলযুগেও চশমার ব্যবহারের উল্লেখ ছিল বলে দাবি ইতিহাসবিদদের একাংশের। বিভিন্ন নথি বলে, ভারতীয় চশমায় দেবদেবীদের মূর্তি খোদাই করা থাকত নোজ-প্যাডের জায়গায়, যাতে ব্রিটিশ আমলে বিলেত থেকে আসা চশমা ভারতীয়দের না গছানো যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, কিছু নথিতে এমনও দাবি করা হয়েছে যে, ভারত থেকেই চশমার আবিষ্কার হয়।
চশমার আবিষ্কর্তা হিসেবে অবশ্য ভারতের কোনও স্বীকৃতি মেলেনি। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি ব্যবস্থা চালুর পরেও দেবদেবীর সঙ্গেই নানা রকমের মূর্তি, এমনকি পরে রাজা বা জমিদারদের চারিত্রিক গুণাবলি বোঝাতেও চশমায় ঘোড়া, কাঁকড়াবিছের মতো নানা জীবের নকশা খোদাইয়ের চল ওঠে। এই সব দিক বিচার না করে এনজেপি-র চশমাকেও যে মূল্যহীন বলা যায় না, তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই।
প্রাচীন চশমা পেলেই তার সঙ্গে নানা ‘মিথ’ জুড়ে যায়। এনজেপি থেকে উদ্ধার চশমার ক্ষেত্রেরও তার অন্যথা হয়নি। রটে যায়, সেটি জাদু চশমা। তা দিয়ে নানা কিছু দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সবুজ চশমা’ গল্পে। প্রফেসর শঙ্কুর গল্পেও টেলিস্কোপ এবং মাইক্রোস্কোপের একটি সংমিশ্রণ, ‘ওমনিস্কোপ’ তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এনজেপি-র চশমাতেও তেমন সব গপ্পো জুড়ছে ক্রমশ। এবং তাকে রহস্যময়ও করে তুলছে।